শিক্ষককে বলা হয় জাতির নির্মাতা। তবে শিক্ষক থেকে সঠিকভাবে জ্ঞান অর্জনের জন্য ছাত্রের পক্ষ থেকে বিনয়, ভদ্রতা ও শ্রদ্ধা এবং শিক্ষকের পক্ষ থেকে হিতাকাঙ্ক্ষা, স্নেহ ও দিকনির্দেশনা অপরিহার্য। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ইসলামে পারস্পরিক দায়িত্ব, সম্মান, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ সম্পর্ক যত সুন্দর হবে, ততই জ্ঞানার্জন হবে কার্যকর ও ফলপ্রসূ।
নবী (সা.) একজন আদর্শ শিক্ষক : প্রিয় নবী (সা.) ছিলেন মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, ‘আমি তো শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৫)
তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অতুলনীয়। তিনি কখনো শিক্ষার্থীদের ওপর কঠোরতা প্রদর্শন করেননি। সাহাবি মুয়াবিয়া ইবন হাকাম (রা.) বলেন, ‘একবার আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে নামাজরত ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি (নামাজের মধ্যে) হাঁচি দিল। প্রতি উত্তরে আমি ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বললাম। লোকজন তখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে।
আমি বলে উঠলাম, আপনাদের কী হয়েছে? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? লোকজন তাদের ঊরুতে হাত চাপড়িয়ে আমাকে শান্ত ও চুপ হতে ইঙ্গিত করল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসুল (সা.) সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করলেন। আমার পিতা-মাতা তাঁর প্রতি উৎসর্গিত হোন, তাঁর মতো এত উত্তম ও সুন্দর শিক্ষাদানকারী কোনো শিক্ষক তাঁর আগেও কাউকে দেখিনি এবং তার পরেও দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে না প্রহার করলেন, না তিরস্কার করলেন, না ধমক দিলেন।
তিনি বলেন, আমাদের এই নামাজ মানুষের কথাবার্তার উপযোগী নয়; বরং এ তো হলো—তাসবিহ, তাকবির ও তিলাওয়াতে কোরআন। (মুসলিম, হাদিস : ৫৩৭)
শিক্ষকের প্রতি বিনয় ও ভদ্র আচরণ : ইলম বা জ্ঞান এমন এক সম্পদ, যা অহংকার ও গর্বের দ্বারা অর্জন করা যায় না। এ জন্য ছাত্রকে অবশ্যই শিক্ষকের সামনে বিনয় প্রদর্শন করতে হবে। মুসা (আ.) আল্লাহর শীর্ষস্থানীয় নবী ও রাসুল হওয়া সত্ত্বেও খিজির (আ.)-এর কাছে ইলম শেখার জন্য তাঁর সাহচর্য কামনা করে অতি বিনয়ের সঙ্গে প্রার্থনা করেছিলেন। মুসা (আ.) একাধারে বনি ইসরাঈলের নবী, আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাওরাত দ্বারা সম্মানিত করেছেন, তিনি আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন এবং তাঁকে বড় ধরনের মোজেজা দ্বারা সম্মানিত করা হয়েছে। এত মর্যাদার অধিকারী হয়েও তিনি খিজির (আ.)-এর সঙ্গে যে বিনয় প্রদর্শন করেছেন তাতে বোঝা যায়, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে বিনয়, ভদ্রতা ও নম্রতার আচরণ একান্ত কাম্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুসা তাকে [খিজির (আ.)] বললেন, আমি এ উদ্দেশ্যে আপনার অনুগমন করতে পারি, যে ইলম শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আপনাকে, আমাকে তা থেকে কিছু কল্যাণকর বিষয় শিক্ষা দেবেন।’ (অর্থাৎ অনুমতি হলে কয়েক দিন আপনার সঙ্গে থাকি এবং আপনাকে যে বিশেষ জ্ঞান দান করা হয়েছে তার কিছু অংশ অর্জন করি)। (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৬৬)
‘মুসা বলল, আল্লাহ চাইলে আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন, আমি আপনার কোনো নির্দেশই লঙ্ঘন করব না।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৬৯)
ছাত্রের প্রতি হিতাকাঙ্ক্ষা : শিক্ষক শুধু জ্ঞানদানকারী নন, বরং তিনি ছাত্রদের একনিষ্ঠ কল্যাণকামী। শিক্ষকদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে বিষয়টি প্রকাশ পেতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের এ বাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই মানুষ তোমাদের অনুসারী হবে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন দ্বিন শেখার জন্য তোমাদের কাছে আসবে। যখন তারা আসবে, তোমরা তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী হবে এবং তাদের সদুপদেশ দেবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৬৫০)
শিক্ষক পিতৃতুল্য : শিক্ষক ছাত্রদের জন্য শুধু জ্ঞানদানকারী নন, বরং তিনি পিতার মতো দয়ালু, স্নেহশীল ও কল্যাণকামী। নবীজি (সা.) হলেন মোমিনের জন্য পিতৃতুল্য। একজন পিতা যেমন তাঁর সন্তানদের বিভিন্ন আদব-শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে থাকেন, ঠিক তেমনই রাসুলুল্লাহ (সা.) মোমিনদের মাসআলা-মাসায়েল, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেন। এমনকি মলমূত্র ত্যাগ এবং টয়লেট নির্বাচনে স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিও তিনি শিক্ষা দিতেন। আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য। তোমাদের আমি দ্বিন শিক্ষা দিয়ে থাকি।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৮)
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষা হলো আল্লাহর এক মহান নিয়ামত, আর শিক্ষক সেই নিয়ামতের বাহক। তাই ছাত্রের কর্তব্য শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করা, আর শিক্ষকের দায়িত্ব ছাত্রকে স্নেহ-মমতায় শিক্ষিত করে তোলা।
