খায়রুল হকের বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় হাসিনা

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রধ্বংসের সহযোগীদের অন্যতম ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে তিনি দেশের বিচারব্যবস্থাকে চরমভাবে বিতর্কিত ও ধ্বংস করে গেছেন।

সেনাসমর্থিত জরুরি সরকারের সহায়তায় ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য নানা কারসাজির আশ্রয় নেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল বিচার বিভাগ কবজা করা। সিনিয়র ও যোগ্যদের ডিঙিয়ে জুনিয়রদের পদোন্নতি এবং বিতর্কিত দলীয় লোকদের বিচারক পদে নিয়োগ দিয়ে বিচারব্যবস্থাকে তিনি প্রথমেই দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত করেন।

শেখ হাসিনার এই দলবাজ বিচারকদের তালিকায় শীর্ষ নামটি—খায়রুল হক। দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতির বিপরীতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে তিনি সর্বোচ্চ আদালতে কাজ করে গেছেন। তার দেওয়া একটি পূর্ণ ও একটি সংক্ষিপ্ত রায়ের অজুহাতে শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধনের নামে গোটা সংবিধান তছনছ করে দেন। দেশের মানুষ জানে, বিতর্কিত বিচারপতি খায়রুল হক জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করেও বক্তব্য রেখেছিলেন। খায়রুল হক দাবি করেছিলেন, তিনি নিজেই রায় দিয়ে সংবিধান যথেচ্ছ বদল করে দিতে পারেন। তার এ কথার প্রেক্ষিতে তৎকালীন হাসিনা সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের পর সংবিধান রদবদল করে তা গেজেট আকারে ছাপিয়েও ফেলেছিল। কিছুদিন পর তারা বুঝতে পারেন সংবিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার বিচার বিভাগের নেই। পরে সংবিধান সংশোধন পার্লামেন্টেই করা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনার ইঙ্গিতে বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে মামলার বিতর্কিত রায় দেন। অবসরে যাওয়ার কিছুদিন আগে ২০১১ সালের ১০ মে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশটি দেন। রায়ে বলা ছিল, ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। অথচ সুদীর্ঘ ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত রায়ের চূড়ান্ত লিখিত আদেশে বিচারপতি খায়রুল হক কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে বলে নির্দেশনা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায়ে স্বাক্ষর করেন। লিখিত এই রায়ে পরবর্তী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে—বিষয়টি ছিল না। অবসরে গিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নিজের দেওয়া আদেশ কোনো রকম অতিরিক্ত শুনানি ছাড়াই পাল্টে দেন, যা ছিল নজিরবিহীন এবং বিচারদর্শনের গুরুতর লঙ্ঘন। সংসদে ২০১১ সালের ৩০ জুন বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এ আইনের ২০ ও ২১ ধারাবলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ উন্মুক্ত করে। এর ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ‘বিনা ভোটের নির্বাচন’, ২০১৮ সালে ‘নিশিরাতের ভোট’ এবং ২০২৪ সালে ‘ডামি নির্বাচনের’ প্রহসন করেন। খায়রুল হকের রায়ের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ওই তিনটি নির্বাচনের আগের তিন মাস নিজেকে কথিত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দাবি করতেন।

প্রধান বিচারপতি থাকাকালে দেওয়া সংক্ষিপ্ত রায় এবং অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর ওই সংক্ষিপ্ত রায় পরিবর্তন করে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায় দেওয়াকে বিচারপতি খায়রুল হকের বিচারদর্শনের লঙ্ঘন এবং নজিরবিহীন বিচ্যুতি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তারই সহকর্মী আপিল বিভাগের ভিন্নমত পোষণকারী তিনজন বিচারপতি। বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত খায়রুল হকের রায় নিয়ে অভিমত দেন যে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হলে তা জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে গঠন করতে হব’—এ শর্ত সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ খায়রুল হকের সংক্ষিপ্ত আদেশটিতে এ কথাগুলো ছিল না। এ সম্পর্কে বিচারপতি ইমান আলী অভিমত দিয়েছিলেন যে, শর্তটি সংক্ষিপ্ত আদেশে ছিল না। কিন্তু আমার বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিচ্যুতি এটিই। সহজভাবে বললে বিচ্যুতিটি হচ্ছে : আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছিল, আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। আর চূড়ান্ত আদেশে এটি করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেন বিচারপতি খায়রুল হক। তার এই রায়ের সুযোগেই শেখ হাসিনা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছিলেন। বিচারপতি খায়রুল হকের সহযোগী হিসেবে ছিলেন মোজাম্মেল হোসেন, এস কে সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। পরে এদেরও শেখ হাসিনা পুরস্কার হিসেবে প্রধান বিচারপতি করেছিলেন। এদের কারণেই দেশে রাজনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে।

প্রধান বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায় দেন। তিনি হাইকোর্টে থাকাকালে মুজিব হত্যার মামলার রায়, মুন সিনেমা হল নিয়ে করা একটি মামলার অজুহাতে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ও জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসংক্রান্ত বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের বিরুদ্ধে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণফোরামসহ বিভিন্ন পক্ষের রিট হয়েছিল। রিভিউ আবেদনগুলোতে বলা হয়েছিল, জনগণের রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়। তাই এটি সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামোতে পরিণত হয়েছে, যা বাতিল করা যায় না। রিটগুলোর শুনানি সম্পন্ন হয়েছে। উচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের আদেশ দিয়েছে।
সূত্র:আমারদেশ

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন