রোগীর মৃত্যু,হাসপাতাল ভাঙচুর এবং গুজব
সম্প্রতি সিলেটের এক হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ ছিল ভুল চিকিৎসার কারণে রোগী মারা গেছেন। এ ধরনের ঘটনা দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। একদিকে ভুল চিকিৎসা রোগী ও পরিবারের জন্য অসহনীয় ক্ষতি বয়ে আনে, অন্যদিকে ভাঙচুরের মাধ্যমে হাসপাতালের সম্পদ ধ্বংস হয় এবং সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই এক্ষেত্রে প্রয়োজন আইনি তদন্ত, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা।
হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি সত্ত্বেও সব রোগ সারানো সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো—প্রত্যেক মৃত্যু নিয়েই কিছু সুযোগসন্ধানী চক্র গুজব ছড়াতে চায়। তারা স্বাভাবিক মৃত্যুকেও ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার ফল হিসেবে উপস্থাপন করে সাধারণ মানুষকে উসকে দেয়। এর ফলে হাসপাতালে ভাঙচুর, বিশৃঙ্খলা এবং চিকিৎসা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে।
এ ধরনের পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ভয়-ভীতি নিয়ে কাজ করলে এর ক্ষতি সাধারণ মানুষকেই ভোগ করতে হয়। সিলেট অঞ্চলে যদি এমন প্রবণতা বাড়তে থাকে, তবে এর ফলে চিকিৎসা সেবার মান নষ্ট হবে এবং সুস্থ-সবল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে উঠবে না।
তাই রোগীর স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও দায়িত্বশীল হতে হবে রোগীর পরিবার, সমাজ ও গণমাধ্যমকে। তদন্ত ছাড়া গুজব ছড়ানো বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা সিলেটের জন্য শুভ নয়। বরং সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাই হতে হবে সবার লক্ষ্য।
মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো স্বাস্থ্য। আর অসুস্থ হলে মানুষ সবচেয়ে আগে যে প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে, সেটি হলো হাসপাতাল। রোগীর জীবন রক্ষায় হাসপাতাল হলো ভরসার শেষ ঠিকানা। তাই হাসপাতাল ও রোগীর সম্পর্ক শুধু সেবাদান ও গ্রহণের সম্পর্ক নয়, বরং এটি একটি মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক বন্ধন।
হাসপাতালের প্রধান দায়িত্ব হলো রোগীকে সঠিক চিকিৎসা, মানসম্মত সেবা ও মানসিক আশ্বাস দেওয়া। একজন মানুষ যখন হাসপাতালে যায়, তখন সে শুধু ওষুধ কিংবা অপারেশনের জন্য নয়, বরং জীবনের প্রতি নতুন করে ভরসা খুঁজে নিতে যায়। ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীরা তাই কেবল চিকিৎসা প্রদানকারী নন—তারা আসলে রোগীর আশা জাগানিয়া, সাহস যোগানো মানুষ। একজন অসুস্থ মানুষ যখন চিকিৎসকের আন্তরিক দৃষ্টি, সহমর্মিতাপূর্ণ কথা ও সান্ত্বনাদায়ক আচরণ পান, তখন তার মনে জীবনের প্রতি আস্থা ফিরে আসে। অনেক সময় এই মানসিক আশ্বাস ও ইতিবাচক মনোভাবই রোগ নিরাময়ের পথে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে হাসপাতাল কেবল রোগ নিরাময়ের স্থান নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে জটিল অস্ত্রোপচার, নিবিড় পরিচর্যা, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন কিংবা মানসিক চিকিৎসা—সবকিছুতেই হাসপাতাল অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আজকের দিনে উন্নত প্রযুক্তি, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং বিশেষায়িত চিকিৎসক দল ছাড়া কোনো জাতির স্বাস্থ্যসেবা কল্পনাও করা যায় না। তাই হাসপাতালকে শুধু একটি ভবন বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা ভুল হবে; এটি আসলে মানুষের জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত একটি আশ্রয়স্থল।
প্রত্যেক রোগীরই আশা থাকে যে হাসপাতালে গেলে তাকে আন্তরিক যত্ন নেওয়া হবে। ডাক্তার ও নার্সরা মনোযোগ দিয়ে তার সমস্যার কথা শুনবেন, সর্বোচ্চ দক্ষতা ও সততার সাথে চিকিৎসা করবেন এবং রোগীর মর্যাদাকে সবসময় সম্মান করবেন। রোগীর প্রতি সদাচরণ, সহানুভূতি ও যত্নশীলতা চিকিৎসার অর্ধেক কাজ সম্পন্ন করে দেয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে—মানুষের মানসিক শক্তি অনেক সময় ওষুধের চেয়েও বেশি কার্যকর হতে পারে। আর এই মানসিক শক্তি জাগ্রত হয় তখনই, যখন রোগী অনুভব করে সে অবহেলিত নয়, বরং ভালোবাসা ও যত্নের পরিবেশে রয়েছে।
একজন চিকিৎসক বা নার্স যদি শুধু দায়িত্ববোধ নয়, বরং মানবিক ভালোবাসা দিয়ে রোগীর পাশে দাঁড়ান, তবে সেই রোগী দ্রুত সুস্থ হওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। বিপরীতে, যদি সে অবহেলা, কঠোরতা বা অবজ্ঞার শিকার হয়, তবে মানসিক ভরসা হারিয়ে তার শারীরিক সুস্থতার পথ আরও দীর্ঘ হয়।
ডাক্তার ও নার্সরা যদি রোগীর প্রতি আন্তরিক হন, তবে রোগীর পরিবারও তাদের প্রতি আস্থা রাখবে। অন্যদিকে দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতি বা অমানবিক আচরণ আস্থার সংকট তৈরি করে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দরকার সঠিক প্রশিক্ষণ, নৈতিকতার শিক্ষা এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা।
হাসপাতাল হলো মানুষের জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল। অসুস্থ হলে মানুষ ভরসা করে হাসপাতালে যায় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে, কোনো রোগীর মৃত্যু ঘটলেই একটি সুযোগসন্ধানী চক্র বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। তারা স্বাভাবিক মৃত্যুকেও ‘ভুল চিকিৎসা’ বলে প্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। কখনো এসব গুজবের জেরে হাসপাতাল ভাঙচুর ও বিশৃঙ্খলার ঘটনাও ঘটছে।
এমন পরিস্থিতি সিলেটের জন্য একটি বিশেষ সতর্কবার্তা? কারণ এতে একদিকে হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। জরুরি সেবা বন্ধ হয়ে পড়ে, রোগীর আত্মীয়স্বজন আতঙ্কিত হয়ে ওঠে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আশেপাশের সাধারণ মানুষও অযথা ভোগান্তির শিকার হন।
প্রশ্ন উঠছে—সিলেটের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবাকে অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে কি কোনো চক্র ইচ্ছাকৃতভাবে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইছে? এটি কি কেবল আকস্মিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, নাকি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত?
এ বিষয়েও গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।
অন্যদিকে, এ ধরনের ঘটনাই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর। তারা মানসিকভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যান। ভয়ভীতির মধ্যে থেকে আন্তরিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। একজন চিকিৎসক যদি সর্বোচ্চ দক্ষতা দিয়েও কাজ করেন, তবুও ভাঙচুর ও গুজবের আতঙ্কে তিনি তার স্বাভাবিক কর্মস্পৃহা হারাতে পারেন। এর সরাসরি ভুক্তভোগী হয় প্রকৃত রোগীরা। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বিলম্বিত হয়, অনেক সময় জীবন রক্ষার মতো জরুরি পদক্ষেপও নেওয়া যায় না।
ফলে সমগ্র সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণ মানুষ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়, আর হাসপাতাল হয়ে ওঠে ভয়ের জায়গা। এ অবস্থায় সিলেট অঞ্চলে স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ, আধুনিকীকরণ ও সেবা সম্প্রসারণও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই গুজব ও বিশৃঙ্খলার এই প্রবণতাকে অবহেলা করলে তা ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
গুজব ছড়ানো সমাজে অবিশ্বাস বাড়ায়। হাসপাতাল ও রোগীর সম্পর্ক যেখানে আস্থা ও দায়িত্বের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কথা, সেখানে গুজব সেই আস্থাকে ভেঙে দেয়। সিলেটের মতো প্রবাসী নির্ভর অঞ্চলে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। অথচ গুজব ও বিশৃঙ্খলা সেই উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
হাসপাতাল ও রোগীর সম্পর্ক বিশ্বাস, দায়িত্ব ও মানবিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। রোগী হাসপাতালকে আশার আলো হিসেবে দেখে, আর হাসপাতালের প্রতিটি সদস্যের কর্তব্য সেই আশাকে সফলতায় রূপ দেওয়া। ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার কারণে রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়লে হাসপাতালের প্রতি আস্থা ভেঙে যায়, যা সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই হাসপাতালগুলোকে হতে হবে আরও স্বচ্ছ, আধুনিক এবং রোগীবান্ধব। আর রোগীকেও চিকিৎসকের প্রতি আস্থা রেখে নিয়ম মেনে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। এই পারস্পরিক সম্পর্কের দৃঢ়তাই একটি সুস্থ ও মানবিক সমাজ গঠনের ভিত্তি।
তাই এখনই সতর্ক হওয়ার সময়। রোগীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটলেও তা নিয়ে গুজব না ছড়িয়ে তথ্য-প্রমাণ যাচাই করতে হবে। প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আরও স্বচ্ছ হতে হবে, আর জনগণকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে—হাসপাতাল ভাঙচুর বা গুজব ছড়ানো সমস্যার সমাধান নয়, বরং নতুন সংকট তৈরি করে।
অনেক সময় চিকিৎসা সেবাকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। রোগীর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে অতিরিক্ত খরচ চাপিয়ে দেওয়া বা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো মানবিকতার পরিপন্থী।
চিকিৎসা কখনোই ব্যবসা হতে পারে না; এটি নিছক মানবসেবা। একজন অসুস্থ মানুষ যখন হাসপাতালে আসে, তখন সে শুধু অর্থ ব্যয় করে না, বরং তার জীবনকেই ঝুঁকির মধ্যে রেখে চিকিৎসকের হাতে সঁপে দেয়। তাই চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আসতে হবে সেবার মানসিকতা।
এজন্য যতটা সম্ভব চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনা জরুরি। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসা ব্যয় না থাকলে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ কেবল ধনীদের হাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। রাষ্ট্র, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের উচিত যৌথভাবে কাজ করে স্বাস্থ্যসেবাকে সবার জন্য সহজলভ্য করা। চিকিৎসা ব্যয় কমানো মানে শুধু ওষুধ বা ফি কমানো নয়; বরং নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে অতিরিক্ত খরচ বন্ধ করাও এর অন্তর্ভুক্ত।
পরিশেষে বলা যায়—চিকিৎসা পেশাকে ব্যবসা নয়, সেবা হিসেবে দেখার মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত মানবিকতা। চিকিৎসা যদি সেবামুখী হয়, তবে তা শুধু একজন রোগীকে নয়, পুরো সমাজকে সুস্থ ও শক্তিশালী করে তুলবে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক