ইসলামী শরিয়ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। হালাল ও হারামের সীমারেখা আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যেন মানুষ সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝে চলতে পারে। মহনবী (সা.) হাদিসে হালাল, হারাম ও সন্দেহজনক বিষয়ের পার্থক্য তুলে ধরেছেন এবং অন্তরের বিশুদ্ধতার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন-
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ، قَالَ سَمِعْتُهُ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ وَأَهْوَى النُّعْمَانُ بِإِصْبَعَيْهِ إِلَى أُذُنَيْهِ “ إِنَّ الْحَلاَلَ بَيِّنٌ وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ كَالرَّاعِي يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى يُوشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ أَلاَ وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى أَلاَ وَإِنَّ حِمَى اللَّهِ مَحَارِمُهُ أَلاَ وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ أَلاَ وَهِيَ الْقَلْبُ ” .
নু’মান ইবনে বাশীর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি শুনেছিঃ অর্থাৎ- বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, রাবী বলেন; (এ সময় নু’মান তার আঙ্গুল দুটি দ্বারা কানের দিকে ইশারা করেন, নিশ্চয়ই হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট, আর এ উভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়, অনেক লোকই সেগুলো জানে না।
যে ব্যক্তি এসব সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকে সে তার দ্বীন ও মর্যাদাকে নিরাপদে রাখে, আর যে লোক সন্দেহজনক বিষয়ে পতিত হবে সে হারামের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়বে। যেমন কোন রাখাল সংরক্ষিত চারণভূমির পাশে পশু চরায়, আশংকা রয়েছে সে পশু তার ভেতরে গিয়ে ঘাস খাবে। সাবধান! প্রত্যেক রাজারই সংরক্ষিত এলাকা থাকে, সাবধান আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হলো তার হারামকৃত বিষয়গুলো। জেনে, রেখো, দেহের মধ্যে এক টুকরা মাংস আছে।
যখন তা সুস্থ থাকে তখন সমস্ত দেহই সুস্থ থাকে। আর যখন তা নষ্ট হয়ে যায় তখন সমস্ত দেহই নষ্ট হয়ে যায়। স্মরণ রেখো, তা হলো ’কালব’ হৃদয়। (সহিহ মুসলিম হাদিস: ১৫৯৯)
হাদিসের ব্যাখ্যা
হালাল ও হারাম স্পষ্ট
ইমাম নববী (রহ.) বলেন: ‘এটি ইসলামের একটি অন্যতম দিকনির্দেশনামূলক হাদিস।
এতে জানানো হয়েছে যে, কোরআন ও সুন্নাহতে বহু বিষয় স্পষ্টভাবে হালাল ও হারাম বলে নির্ধারিত।’ (শরহ মুসলিম, নববী, ১১/২৭) হালাল মানে: যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) স্পষ্টভাবে অনুমোদন করেছেন। হারাম মানে: যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) ﷺ স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। এই দুয়ের মধ্যে কোনো দ্ব্যর্থতা নেই। যেমন—নামাজ, সাদকা, হালাল খাদ্য; আর হারাম হলো—মদ্যপান, সুদ, ব্যভিচার, চুরি ইত্যাদি।
সন্দেহযুক্ত বিষয়সমূহ (الشبهات)
এগুলো এমন বিষয়, যার বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ সাধারণ মানুষের কাছে অজানা থাকে—যেমন, কোনো খাবার বা আয় হালাল না হারাম তা নিশ্চিত নয়। ইবনে হাজার আল-আসকালানী (রহ.) বলেন: ‘এই সন্দেহজনক বিষয়গুলো আলেমদের কাছে পরিষ্কার, কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তা অস্পষ্ট। তাই নবী (সা.) তাদের সাবধান করেছেন যাতে তারা নিজেদের দ্বীন রক্ষা করতে পারে।’ (ফাতহুল বারী, ১/১২৭)
ইমাম নববী বলেন: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহভীরুতার কারণে সন্দেহজনক জিনিসও ত্যাগ করে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদাকে নিরাপদ রাখে।’
(শরহ মুসলিম)
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) এ বিষয়ে বলেন: ‘যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকে, সে আসলে আল্লাহর ‘সংরক্ষিত সীমানা’ থেকে দূরে অবস্থান করছে—এটাই তাকওয়ার পরিপূর্ণতা।’ (ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ইন, ১/৪৩)
সংরক্ষিত চারণভূমি (الحِمى)
রাসুল (সা.) উদাহরণ দিয়েছেন একজন রাজা ও তার সংরক্ষিত এলাকার। যেমন রাখাল যদি সীমার কাছে পশু চরায়, একসময় পশুগুলো ভিতরে ঢুকে পড়বেই।
ইবনু রজব আল-হানবলী (রহ.) বলেন: ‘এই উপমার মাধ্যমে মহানবী (সা.) বোঝাতে চেয়েছেন—যে ব্যক্তি হারামের কাছাকাছি যায়, সে অবশেষে তাতে পতিত হতেই পারে। তাই তাকওয়ার প্রকৃত অর্থ হলো দূরত্ব বজায় রাখা।’ (জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, হাদীস নং ৬)
‘হৃদয়’ বা ‘কালব’-এর তাৎপর্য
মহানবী (সা.) শেষে বলেছেন, ‘দেহে একটি মাংসখণ্ড আছে… তা হলো হৃদয়।’
ইমাম নববী বলেন: ‘হৃদয় যদি সৎ থাকে, তবে মানুষের কর্ম, বাক্য, দৃষ্টি—সব কিছুই সৎ হয়ে যায়; আর হৃদয় যদি বিকৃত হয়, তার প্রভাব পড়ে সব আমলে।” (শরহ মুসলিম)
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) হৃদয়কে বলেন— ‘কলক বা হৃদয় হচ্ছে এমন এক রাজা, যার অধীন পুরো দেহ রাজ্য। যদি রাজা সঠিক পথে থাকে, গোটা রাজ্য সুশাসিত থাকে।’ (ইগাসাতুল্লাহফান, ১/৬৯)
সারসংক্ষেপ:
হালাল-হারাম স্পষ্ট—এগুলোর সীমা অতিক্রম করা মারাত্মক।
সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকা তাকওয়ার চূড়ান্ত রূপ।
আল্লাহর সংরক্ষিত সীমা লঙ্ঘন করা মানে হারামে পতিত হওয়া।
অন্তরের বিশুদ্ধতা (কালবের সাফাই) সকল আমলের ভিত্তি।
