জাতিসংঘে ড. আতিউর
দৈনিক সিলেট ডট কম
এনআরবি নিউজ, নিউইয়র্ক থেকে : ‘প্রতিটি বাঙালির মধ্যেই বিশেষ একটি আবেগ আর চেতনা রয়েছে। যাকে ‘ইনক্লুসিভিটি স্পিরিট’ হিসেবে মনে করা হয়। সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনাকে কাজে লাগিয়ে বাস্তবভিত্তিক কিছু করার চেষ্টা চলছে। সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন এই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নে নিয়োজিত ব্যাংকগুলোকে সাথে নিয়ে এগুচ্ছে। বিশেষ করে, যারা পেছনে পড়ে আছে, তাদের সেবা দিয়ে, ফাইন্যান্স দিয়ে একসাথে নিয়ে যাবার পথ সুগম করছে। পৃথিবীর খুব কম দেশেই অন্তর্ভূক্তিমূলক কর্মকান্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাঙ্কিং সার্ভিস চালু করেছে। যারা আর্থিকভাবে একেবারেই অস্বচ্ছল, তাদেরকে উদ্যোক্তা হওয়ার উৎসাহ দিয়ে ওপরে আনার ক্ষেত্রে তারা আন্তরিক অর্থে কাজ করছেন কৃষি সেক্টরে ফান্ডিং দিয়ে, এসএমই ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে।’ এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. আতিউর রহমান।
জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনের সভাপতি পিটার থমসন এর উদোগে ‘অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক তিনদিনব্যাপি আলোচনা সভার পর ১৫ জুন বৃহস্পতিবার সকালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরের সন্নিকটে এফএফ ভবনে ইউএনডিপির এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ড. আতিউর বক্তব্য রাখেন।
ইউএনডিপির হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অফিসের পরিচালক ড. সেলিম জাহানের সভাপতিত্বে ‘ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুসন এ্যান্ড ইনক্লুসিভ গ্রোথ : দ্য সাকসেস স্টোরি অব মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস’ শীর্ষক এ বিশেষ বক্তৃতামালায় চীন, ভারত, পাকিস্তান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্ধশতাধিক অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাপনা সেক্টরের শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। তবে এ বক্তৃতা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়ায় বিভিন্ন দেশে ইউএনডিপির কর্মকর্তারাও তা অবলোকনে সক্ষম হন।
ড. আতিউর বলেন, ‘জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছিল বিশ্বব্যাপী প্রতিক’লতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যন্ত সময়ে। বাংলাদেশকে পাশ্চাত্যের নেতা তলাবিহীন ঝুরি হিসেবে মন্তব্য করতেও কসুর করেননি। সেই বাংলাদেশ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং মানব-উন্নয়নে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে চলেছে।’ ‘আর এটি সম্ভব হয়েছে আর্থিক, কৃষি এবং স্বাস্থ্য সেক্টরের মত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে স্বউদ্যোগে সামাজিক উদ্যোক্তার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায়। এটিই হচ্ছে মূলভিত্তি সামাজিক বিবর্তন আর উন্নয়নের ক্ষেত্রে। ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ ছোট ছোট উদ্যোক্তারাই বলিষ্ঠ ভ’মিকা রাখছে বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভ’মিকা এক্ষেত্রে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। যা অন্য কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ঘটতে দেখা যায় না’ উল্লেখ করেন ড. আতিউর।
ড. আতিউর বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন মোবাইল ব্যাংকের একাউন্টের সংখ্যা ৪ কোটিরও বেশী। বিশ্বের আর কোন দেশে এতটা নেই। বাংলাদেশে এটি সম্ভব হচ্ছে কারণ, এজন্যে একটি নিয়ম-নীতি রয়েছে। একজন বা একপক্ষ আরেকপক্ষের অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে পারেন এই রেগুলেশনের ভিত্তিতে। সম্মুখে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে পার্টনারশিপের বিকল্প নেই। আর এই পার্টনারশিপে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক, এনজিও, ব্যক্তি বিশেষ। বাংলাদেশ আর্থিকভাবে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে এটিও বড় একটি অবলম্বন।’
‘সুখের কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ কখনো অন্যের মুখাপেক্ষি হয়নি। নিজেরাই বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করছে। সফলতা না এলে, আবার নবউদ্যমে শুরু করছে। অর্থাৎ উদ্যোগ থেকেই তারা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নবউদ্যমে এগুচ্ছেন। এমন উদাহরণও বিশ্বে আর কোথায়ও নেই। আর্থিক স্বয়ম্ভরতা অর্জনে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলার এই প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে সবল হচ্ছে। অর্থাৎ আপামর জনগোষ্ঠি নতুন নতুন উদ্যোগের সাথে পরিচিত হচ্ছে, অভিজ্ঞতা অর্জন করছে এবং আস্থার সাথে তা গ্রহণ করছে’-মনে করেন ড. আতিউর।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়নের গতি ক্রমান্বয়ে ত্বরান্বিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শিতাপূর্ণ নেতৃত্বেও মধ্য দিয়ে-এমন তথ্য উপস্থাপন করে ড. আতিউর বলেন, ‘আমরা এক্সপেরিমেন্ট করি, যদি ভুলও হয়, সেখান থেকে শিখি, এবং শেখার পরই নতুন করে চলার পথ বের করি। এটি বাংলাদেশের একটি মডেল। আমাদের মোবাইল ফাইন্যান্সিংয়ের সার্ভিস এখন শুধু অর্থ লেন-দেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, স্কুল শিক্ষকদের বেতন প্রদান, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রবীন-বিধবাদের ভাতা প্রদান, এরকম অনেক অত্যাবশ্যকীয় সেক্টরেই তা কাজে লাগছে।’
‘একটি কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, এসব কার্যক্রম ব্যাংকের অধীনে থাকায়, সাধারণ মানুষের আস্থাও বেড়েছে। একইসাথে সরকারেরও নজর রয়েছে এসব কার্যক্রমের ওপর। এভাবেই বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আজ সারাবিশ্বের জন্যে মডেলে পরিণত হয়েছে’-দাবি ড. আতিউরের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. আতিউর রহমানের এ বক্তব্যে সকলে অভিভূত এবং অনেকেই উচ্ছ্বসিত চিত্তে উচ্চারণ করেন যে, ‘বিশ্বের বহুদেশ এখন বাংলাদেশের এই অন্তর্ভূক্তিমূলক থিউরি অনুসরণ করছে।’
ড. সেলিম জাহান তার সমাপনী মন্তব্যে উল্লেখ করেছেন, ‘সারাবিশ্বের অর্থনীতি যখন টলটলায়মান ছিল, তখোনও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল এবং এখন তা গতিশীল হয়েছে, এর অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উন্নয়নমুখী ভূমিকা পালন করেছে।’ ড. জাহানের মতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথ সুগম হবার নেপথ্যে‘ ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল অন্তর্ভুক্তি’র ভ’মিকা অপরিসীম। এজন্যে তিনি তার সকল সহকর্মীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন বাংলাদেশের সাফল্যের এই গল্প নিজ নিজ দফতরের সকলকে অবহিত করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথ সুগম করার জন্যে।