আসুন ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অসহায় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াই
দৈনিক সিলেট ডট কম
আবদুল বাছেত (মিলন):বর্তমান বিশ্বের উল্লেখ্য যোগ্য ঘটনা রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্বিচারে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চলছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর চলছে নির্যাতনের স্টিম রোলার। উগ্রবাদী বৌদ্ধ জঙ্গিরা মুসলিম হত্যার মহা উৎসবে মেতে উঠেছে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে খুন। যুবতীদের লাইনে দাড় করিয়ে নারী ধর্ষণ এবং বস্ত্রহরণ করে গাছে বেঁধে উল্লাস, কুপিয়ে, পিটিয়ে হত্যা, গলা কেটে পাত্রে রক্ত জমা রেখে প্রদর্শন, পুড়িয়ে মারা হচ্ছে জীবন্ত মানুষকে, এমন কোন নির্যাতন নেই যা রোহিঙ্গাদের উপর চালানো হচ্ছে না। কোনো মানুষ তা সহ্য করা সম্ভব নয়। গলায় রশি লাগিয়ে রাস্তায় টানা হচ্ছে, নারীদের সম্ভমহানি করছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী, রোহিঙ্গা মুসলিমদের সম্পদ লুন্ঠন করছে এবং তাদের অধিকার হরণ করেছে। নাফ নদীতে রোহিঙ্গা মুসলিম নারী – শিশুদের লাশ ভাসছে। সন্ত্রাসীরা নারীদের শুধু ধর্ষণেই করছে না, তাদের দেহ কেটে ছিন্ন- ভিন্ন করে দিচ্ছে, আরকানে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিমূর্লের প্রতিবাদে বিশ্ব মুসলিমদের কে এ অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বের সচেতন মানুষগুলো জেগে উঠতে শুরু করেছে, যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। মিয়ানমারের প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আহবান রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ করো, নিন্দার ঝড়, বিক্ষোভে উত্তাল গোটা দুনিয়া। নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যে যে পথে পারছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। ধানক্ষেত পেড়িয়ে কর্দমাক্ত পাহাড়ি পথ দিয়ে আর নৌকাযোগে দু-দেশের সীমান্ত ভাগ করা নাফ নদীতে পাড়ি দিয়ে ছুটেছে বাংলাদেশের দিকে। এই পরিস্থিতিকে জাতিসংঘ দেখছে মানবিক বিপর্যয় হিসেবে। মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ তুলছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো, বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রমাণের চেষ্ঠা করে দায়িত্ব অস্বীকার করতে চায়। তবে রোহিঙ্গারা নিজেদের মায়ানমারের নাগরিক বলেই জানে। ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত প্যানলং সম্মেলনের সর্বসম্মতি সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৪৮ সালে ৪ঠা জানুয়ারি বার্মার স্বাধীনতা লাভের পর রোহিঙ্গা জাতিগত পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করেন। ২০১০ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী পরিচয়পত্র “সাদা কাগজ” প্রথার প্রচলন হয়েছে। ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওযা হয় নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে ২০১২ সালেই শত শত রোহিঙ্গা দেড় লাখ গৃহহীন আর শিশুদের পুড়িয়ে মারার দৃশ্যে বিবিসি প্রকাশ করেছিল। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বর্তমানে বিশ্ব চুপ করে বসে নেই। হামলা-নির্যাতনের শিকার হয়ে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের সহায়তার জন্য ত্রাণ নিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন তুরস্কে ফার্স্টলেডি এমিনি এরদোগান। বিপন্ন রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্ষার জন্য বিশ্ব সম্প্রাদায়কে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশের ইসলামি সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন সহ উলামা মাশায়েখ গণ। মায়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠির ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাউকে তাড়িত করবে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের এ ভয়ানক বিপদে বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর বিশাল দায়ভার। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন- হে মুমিনগণ তোমরা পরস্পর ভাই ভাই, সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃত্বগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো আর আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও। (সূরা হুজুরাত,৪৯ :১০) নির্যাতিত ভাইদের বিপদে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রতিদিনেই সোস্যাল মিডিয়ায় ফেইসবুকে, ইউটিউবে, পত্র-পত্রিকার খবরে দেখা যায়, শোনা যায়, কি নির্মম কাহিনী প্রশ্ন জাগে রোহিঙ্গারা কারা? কি তাদের পরিচয়? কোথায় তাদের বসবাস? কি কারণে তাদের উপর এমন নিমর্ম নির্যাতন? তাদের জন্য বাংলাদেশের কী করণীয়? মানবাধিকার সংস্থাগুলো কী তাদের পক্ষে?
আরকান স্বাধীনতা অর্জনের পরও ১৭৮৪ সালে বিট্রিশ শাসন আসার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫০ বছর এ অঞ্চলের রাজ সভায় মুসলিম রীতি- নীতি ও সংস্কৃতি চালু ছিল। ইউপিকিডিয়া সূত্রে এক সমৃদ্ধ তথ্য বেরিয়ে আসে আরকানের প্রথম সুলতান বা মুসলিম শাসক সুলায়মান শাহ থেকে নিয়ে ১৭ জন সুলতানের শাসন ছিল। এতো সমৃদ্ধ ইতিহাসের পরও আজ তারা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আরকান শব্দটি আরবি ভাষার কোনো শব্দের অপভ্রংশ। পৃথিবীতে মুসলিম জাতির অস্থিত্ব আজ বহুমুখী আগ্রাসন, নির্যাতন ও ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। পশ্চিমাবাদ, পুঁজিবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ একে একে মুসলিম দেশগুলো কে গিলে ফেলার চেষ্ঠা করছে। অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে গৃহহারা-দেশহারা-নিরাশ্রয় মানুষগুলোর খাবার, পানীয়, আশ্রয়, আশা কিছুই নেই। এ যেন মৃত্যুপুরীতে জীবন-যাপন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দেশবাসির একটা আহবান, সীমান্ত খুলে দিন, মিমাংসা পরে হবে, মানুষগুলো কে আগে বাঁচান। রাখাইন সংকট সমাধানে বাস্তব অ্যাকশন দরকার। মুসলিম বিশ্ব কুরবানির চেতনায় মজলুমের পক্ষে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে এখনো সামর্থ হয়নি। ফলে জালেমদের দৌরত্ব অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় প্রাপ্ত তথ্য এবং রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস বইয়ের তথ্য সূত্রে বা অল্প ভাষায় তাদের ইতিহাস বর্ণনা করা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। বর্মী জান্ডা এবং অং সান সুচি বিশ্ব সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্ণিত হয়েছে। তার বিচার বিশ্ব আদালতে করতে হবে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। আরব বিশ্বকে এই বর্বরতার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রুদ্ধদ্বার বেঠক শেষে দেয়া এক সর্বসম্মত বিবৃতিতে অবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে চলমান গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধ করার জন্য মায়ানমার সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে। বিরল হিসেবে বর্ণিত এই বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর, মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করছে। এই সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ওদিকে গণহত্যা বন্ধ করে রোহিঙ্গা সংকটের আশু সমাধান করার আহবান জানিয়ে জাতিসংঘের উদ্দেশ্য খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনুছ সহ ১২ জন নোবেল বিজয়ী এবং ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যাক্তি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং অতিতের বিভিন্ন সময়ে তারা এমন কি নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টের ও সদস্য হয়েছেন। এ ধরণের কিছু তথ্যের উল্লেখ করে বিশিষ্ট জনেরা বলেছেন ১৯৮০ দশকে ক্ষমতা দখলকারী – সামরিক শাসকরা কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। সেই থেকে পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বেড়েছে এবং বিগত কয়েক মাসে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন দেশের রাষ্টদূত ও হাইকমিশনারদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরাও একই ধরণের বক্তব্য রেখেছেন এবং আহবান জানিয়েছেন। আমরা আশা করতে চাই, বিশ্ব জনমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে অবিলম্বে গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধ করা হবে এবং সকল রোহিঙ্গাকে তাদের নিজেদের দেশ মায়ানমারে ফিরে যাওয়ার এবং আইন সম্মত নাগরিক হিসেবে মর্যাদা ও অধিকারের সঙ্গে বসবাস করার সুযোগ দেয়া হবে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কে প্রধান করে গঠিত ঐ কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও আইনসম্মত সকল অধিকার দিয়ে গণহত্যা বন্ধ করার এবং সমস্যার সমাধানে পৌঁছানোর সুপারিশ করেছিল। অন্যদিকে সুচির সরকার এমন এক রাখাইন রাজ্যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে যেখানে কোনো জীবিত রোহিঙ্গা থাকবে না। এ জন্যেই বিষয়টিকে সুচির সরকারে ‘সেরা উপহাস’ হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়েছে। এই উপহাসের মধ্যে দিয়ে মায়ানমার আসলে জাতিসংঘসহ সমগ্র বিশ্বের সঙ্গেই চরম সীমালঙ্গন করতে শুরু করেছে। রোহিঙ্গাদের ৪৭১টি গ্রামের মধ্যে ১৭৬ টি গ্রাম এখন জনমানব শূন্য। এ ছাড়াও ৩৪টি গ্রামে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ আছে। হে আল্লাহ রোহিঙ্গা অসহায় মুসলমানদের জন্য তোমার কুদরতি সাহায্য পাঠাও, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ধর্য্য ধারণের তাওফিক দাও। আসুন ধর্ম, বর্ণ ,দল মত নির্বিশেষে অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়াই।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট