একটি দিন আনিসুল হকের সাথে

দৈনিক সিলেট ডট কম
সেলিম আউয়াল: সন তারিখ মনে নেই।তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে বলা না বলা নামের একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচার হতো। সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন আনিসুল হক। অনুষ্টানের শুরুতে টিভির পর্দায় একটি নাম দেখা যেতো, তথ্য ও গবেষণা ‘মকবুল চৌধুরী’। সেই মকবুল হচ্ছেন আজকের বিশিষ্ট ফিল্ম মেকার মকবুল চৌধুরী।আরেকভাবে বলা যায় শাহী ঈদগাহ-র ফ্লাসের মকবুল। তখন মকবুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র। সেইসব দিনগুলোতে আমি প্রায়ই সপ্তাহ-পনেরো দিনে একবার ঢাকা যেতাম।আমার তখন ব্যবসা ছিলো। চকবাজার থেকে পাইকারী দরে মালামাল কিনতাম।সারাদিন কেনাকাটার পর বাকী সময় কাটতো মকবুলের সাথে।প্রায়ই আমি বাড়তি একদিন থাকতাম শুধু মকবুলের সাথে ঘোরাঘুরি করার জন্যে। মকবুলের সাথে ঘুরাঘুরি মানে ফিল্ম ফ্যাস্টিব্যালে যাওয়া, নানা গুণী জনের সাথে আড্ডা। আর ছিলো মকবুলের আলোচনা। মকবুল একাই কথা বলে যেতো, আমি ছিলাম গুণমুগ্ধ শ্রোতা।প্রায়ই আমি আর মকবুল চার পাঁচ ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম গল্প করে করে।
সেই দিনগুলোর একদিন ঢাকা গিয়েছি।উঠেছি মকবুলের মেসে।সেদিন ছিলো হরতাল। মকবুল বললো চলো আনিস ভাইয়ের বাসায় যাই। হেটে না রিকসায় গিয়েছিলাম মনে নেই। মনে হয় সকাল দশটার দিকে গিয়েছিলাম, আর ফিরেছিলাম বিকেলে।
মকবুলকে আনিস ভাই দেখতেন ভাইয়ের মতো, বন্ধুর মতো। আমাদেরকে নিয়ে আনিস ভাই ঢুকেন তার বেডরুমে।শুধু খাবার জন্যে আমরা একবার ডাইনিং রুমে এসেছিলাম, আর বাকী সময়টা কাটে তার বেডরুমে।আমরা চার জন, মকবুল, আনিস ভাই, ভাবী আর আমি। ভাবী এসএসসি-তে প্লেস পেয়েছিলেন, সম্ভবত টিভিতে বিতর্ক করতেন ইত্যাদি।আমাদের আড্ডার বিষয় ছিলো কতো কিছু।পুরো সময়ই মনে হলো, মকবুল একাই বক্তা। আমি আনিস ভাই আর ভাবী শ্রোতা।
দুপুরে যখন খেতে বসি, বিশাল ডাইনিং টেবিল জুড়ে অসংখ্য পদের খাবার। কোনটা রেখে কোনটা খাই।আমাদের সাথে টেবিলে আনিস ভাইয়ের ছেলে। তখন সে সম্ভবত ফাইভ সিক্সের ছাত্র। মজার ব্যাপার সে শুধু ডাল দিয়েই খেলো। তার আর কিচ্ছু খেতে ভাল্লাগছে না। টেবিলে বিশাল আকারের রুপচাঁদা মাছ। ভা্জা, টোস্টের মতো। ভাবী তুলে দিলেন আমাদের পাতে। আমরা তো মাছ ভাজার সাথে মশলা ছাড়া আর কিছু মেশাই না। ভাবী বার বার বলছিলেন ভাজা মাছের সাথে ডাল নেন। মনে পড়ছে না, সম্ভবত: দ্বিতীয় পিস রুপচাঁদা খাবার সময় ডাল নিয়েছিলাম।
গল্পের শেষ এখানে নয়। হরতালটা আধাবেলার ছিলো, অথবা বিকেলের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।আনিস ভাই আমাদেরকে নিয়ে বের হন, তার গাড়িতে করে।তারপর মকবুলের মেসে নামিয়ে দেন।
তারপর আর যোগাযোগ নেই।মকবুল দেশের বাইরে।একদিন শুনি আনিস ভাই এফবিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট।আমি ভাবি বলা না বলা অনুষ্ঠানের সেই অানিসুল হক কি এই প্রেসিডেন্ট।অনেক পর কনফার্ম হই।তারপর একদিন শুনি সেই আনিসুল হক ঢাকার মেয়রপ্রার্থী, তারপর মেয়র। মেযর হবার পরও মকবুলের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো।
আনিসুল হক লন্ডনে চিকিৎসা নেবার পর প্রায়ই গুজব রটতো, তার মৃত্যুর।আমি মকবুলের কাছ থেকে তার সর্বশেষ তথ্য নিতাম।তখনই জানতাম অলৌকিক কোন ঘটনা ছাড়া তার ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। মকবুল বলতো, এগুলো কাউকে বলো না।
তারপর ফুরায় এ জীবনের লেনদেন,আমাদের প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।আনিসুল হকও সেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করলেন।একজন মুমিনের স্বাদ, জান্নাতুল ফেরদৌস লাভ করা। আনিস ভাইয়েরও জন্যেও কামনা করবো জান্নাতুল ফেরদৌস।আল্লাহ মহান, ক্ষমাশীল।