রাজনীতির সুবচন নির্বাসনে?
দৈনিক সিলেট ডট কম
হাসান হামিদ:লেখাটি শুরুর আগে একজন বাঙালি সম্পর্কে বলে নিই, যার নিন্দায় বেশ কিছুদিন ধরে আমরা বন্যায় ভাসিয়েছি এদেশ। অথচ ইটালীর বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লু্ইজার তাঁকে নিয়ে লেখা বই পড়ে তাঁর ভক্ত হন। জাপান থেকে এটি বের হয়েছে সেই দেশের শিশুদের জন্য। আর ফ্রান্সের সিটি ইউনিভার্সিটি তাঁর লেকচারের আয়োজন করেছিল। আমরা জানি, মাত্র ২ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়েছে এর অন-লাইন রেজিষ্ট্রেশন। ভারতের টাটা গ্রুপের ২৪টি কোম্পানি শুরু করেছে তাঁর প্রবর্তিত সামাজিক ব্যবসা। আর সেই ড. ইউনুসকে আমরা কালিমা লেপনে দারুণভাবে ব্যস্ত হই; তিনি রাজনীতি করবেন বলে তাঁকে গালাগাল দিই! আর ভাবি, আহা আমরা কতো মহান। অথচ বিশ্বের ৩০টি দেশের ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনূস সেন্টার প্রতিষ্ঠিত করেছে তাঁর চিন্তাচেতনা নিয়ে গবেষণার জন্য। তাঁকে নিয়ে সারা বিশ্বের মাতামাতি চলছে যখন তখন নিজের দেশে তিনি প্রায় অবাঞ্ছিত। কিন্তু তাতে ইউনূস সাহেবের ক্ষতি হচ্ছে? নাকি অন্যদের অন্য কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা আজকাল কাছে পাই না আমাদের নোবেল আলোকিত করা ব্যক্তিত্বকে! আসলে এমনটি হয়ে আসছে অনেক দিন ধরেই এদেশে!
আমরা কি তবে পরশ্রীকাতর জাতিতে এভাবেই পরিণত করছি নিজেদের? সামাজিক ও বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে একে অপরকে দোষারোপ করা, একে অন্যের চরিত্রে কালিমা লেপনে আমরা ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। এতে দুটি জিনিস প্রমাণ হয়। এক, আমরা মোটেও দেশ প্রেমিক নই। দুই, আমরা নিজেরা কেউ সৎ নই। এ কালিমা লেপন সমানে চলছে।এমনকি জাতির বিবেক যারা; অর্থাৎ বুদ্ধিজীবিরাও আজকাল এ কুকাজে মেতেছেন। এ নিয়ে ভিনদেশীয় একটি মজার ঘটনা বলে নিই। বিখ্যাত কবি ও সমালোচক স্যামুয়েল জনসন খবর পেলেন তাঁর সময়ের একজন নামকরা রাজনৈতিক নারী কলামিস্ট লেখালেখিতে মনোযোগ কিছু কম দিয়ে ইদানীং রূপচর্চায় মেতেছেন। শুনে জনসন মন্তব্য করলেন, ‘অন্যের চরিত্রে কালিমা লেপনের চেয়ে নিজের গালে কালিমা লেপন উত্তম।’
আমার মনে হয়, আমরা দেশের ও জনগণের স্বার্থে ভালো কাজ করতে পারি না এ কারণে যে, আমাদের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল। এ জন্যই দোষারোপের রাজনীতি বাংলাদেশে বেগবান। আওয়ামী লীগ খুঁজে বেড়ায় বিএনপির দোষ আর বিএনপি খুঁজে বেড়ায় আওয়ামী লীগের দোষ। কিন্তু নিজেদের দোষ কেউ সংশোধন করেন না। তারা একে অপরকে ভয় পান, কারণ তাদের অপকর্ম এত বেশি যে, জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করা হয়- আমি ভালো সে খারাপ।’ আর এই ‘তুই ভালো না, মুই ভালো’ ঢঙের কথা চালাচালি জোরেশোরেই চলছে আজকাল। একদলের সাধারণ সম্পাদক এখন যা বলছেন, কতক্ষণ পরেই অন্যদলের মহাসচিব তার বিরোধিতা করছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রচুর কথা বলছেন এবং স্ববিরোধী কথাও বলছেন। তিনি কেবল বিএনপির বিরুদ্ধে শব্দবোমা নিক্ষেপ করছেন তা নয়। নিজ দলের বক্ষভেদী তীরও তিনি মাঝেমধ্যে ছুড়ছেন। সম্প্রতি এক সভায় তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগকে উল্লেখ করেছেন ‘সাইনবোর্ড সর্বস্ব’ সংগঠন হিসেবে। আর ছাত্রলীগ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ও সরকার খেটেখুটে যে সুনাম অর্জন করে, ছাত্রলীগের একদিনের অপকর্মেই তা ধ্বংস হয়ে যায়।
আজকাল শ্রদ্ধেয় ওবায়দুল কাদেরের বক্তৃতা শুনে কখনো কখনো মনে হয়, তিনি নিজ দলের চেয়ে বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তিত। যেমন সেদিন বলেছেন, আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করবে। এমন ভবিষ্যদ্বাণী তিনি আগেও করেছেন। বিএনপি যদি মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করে তাহলে তো ওবায়দুল কাদের সাহেবদের খুশি হওয়ার কথা। বিএনপির ভালো-মন্দ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে নিজের দলের ভেতরটা একবার ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন না কেন?
একটা বিষয় খুব অবাক করার মতো। এটা কি জনগণ বুঝে না যে, দশম সংসদ ভেঙে না দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচন হলে বিএনপি জয়লাভ করার সম্ভাবনা কতটুকু? তবে যদি সংসদ ভেঙে দিয়ে সর্বদলীয় বা সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় আসার একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এ বিষয়ে এখন থেকেই যথেষ্ট ভাবতে হবে, অভাবনীয় পরিস্থিতিতে তারা কী করবেন? তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথাগুলো বলতে হলো। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি সেনা মোতায়েন ছাড়া হয়, সেটা হতে পারে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো। বিগত আট বছরে প্রশাসনের উচ্চপদে এমন লোক কমই খুঁজে পাওয়া যাবে, যিনি রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মতাদর্শী। পুলিশ, র্যাব, আনসার যারা নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের থেকে কেন্দ্র পাহারাদার হিসেবে থাকবেন, এদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের দর্শনে বিশ্বাসী বড় বড় ক্যাডার বা সমর্থক। ভুক্তভোগী মানুষের সমূহ আশঙ্কা, ভোটার না এলেও ভোট হয়ে যাবে, যেমনটি ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারিতে হয়েছিল। এখন আর জনগণের ভোটের প্রয়োজন পড়ে না যদি প্রশাসনের প্রতিটি লোক সরকারদলীয় হয়। এক বন্ধু বললেন, প্রশাসনের এসব মানুষ যেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক বক্তৃতা দেন। এদের দিয়ে সিইসি কিভাবে নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন উপহার দেবেন, সেটাই জনমনে বড় প্রশ্ন।
বিএনপি নেত্রী কক্সবাজার যাবেন রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের জন্য। সমর্থকেরা তার পাশে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের কোথাও গেলে তার সমর্থকেরাই তাকে স্বাগত জানান। কিন্তু প্রশ্নটা হলো- বিএনপি নেত্রীর আশপাশে সমর্থকেরা ভিড় করতে পারবেন না কেন? কিন্তু ওবায়দুল কাদের ২৭ অক্টোবর এ ভাষায়ই কথা বলেছেন। সরকারদলীয় নেত্রীর জন্য সব জায়গা উন্মুক্ত থাকে। বিরোধীদলীয় নেত্রীর জন্য সব জায়গা অবরুদ্ধ থাকবে কোন কারণে? এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র? এ সব কিছুই বলে দেয়, সেনা মোতায়েন ছাড়া ভিন্ন মতের লোকেরা কেন্দ্রে গিয়ে নিরাপদে ভোট দিতে পারবে না। হয়তো রক্তাক্ত হয়ে অনেককে বাড়ি ফিরতে হবে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। ৩ শ’ আসনে ১৫৪ জনের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ওই নির্বাচনে ছিলেন না। আসলে ভয়ে নির্বাচনে কেউ দাঁড়াননি। পৈতৃক প্রাণটাকে কে না ভালোবাসে বলুন! রাজনীতিকেরা সংশোধনের পথে আসতে হবে। মাঠের বিরোধী দলকে মাঠছাড়া করাই কি ক্ষমতাসীন দলের মিশন ও ভিশন? যদি তা-ই না হয়, তাহলে বিএনপি ও তার জোটকে নির্বাচনী ময়দানে আসতে বাধা দেয়া হচ্ছে কেন? গোটা দেশ সরকারি দলের নেতারা চষে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন সুযাগ-সুবিধা নিয়ে। রাজনৈতিক বক্তব্য অনেকে এমনভাবে দিচ্ছেন, যাতে উসকানির গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। আজকাল অনেক মন্ত্রীর মুখে যেসব কথা উচ্চারিত হয় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে, তা অনেকটা গালাগালির শামিল।
শেষ করবো একটা ঘটনার উল্লেখ করে। ২০০৪ সালের নভেম্বরে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কানাডা সফরে যান। ইরাক অভিযানের কারণে কানাডার সাধারণ মানুষ তাঁর ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিল। কাজেই তিনি অটোয়া পৌঁছানোর পর ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পড়েন। হাজার হাজার কানাডীয় রাস্তায় নেমে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। বুশ এতে একটুও ক্ষোভ প্রকাশ না করে বলেন, ‘কানাডীয়দের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ। আমাকে হাত ছুড়ে বরণ করে নেওয়ার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই।’ আমাদের বড়রা এই ঘটনা থেকে কিছু শিক্ষা নিতে পারেন। পারেন কি?
(লেখক- কবি ও গবেষক)
কলামে প্রকাশিত সব লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে পত্রিকার কোন সম্পর্ক নেই।