একজন সাইদ জামাল ও ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি
দৈনিক সিলেট ডট কম
দৈনিকসিলেটডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস অঙ্গরাজ্যের নিবাসী তাসিন জামাল (১৪) স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় তার ছোটবোন নাহিন চিৎকার করে দৌড়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে। তাদের বাড়ির সামনে একটি কালো রঙয়ের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িটি অভিবাসন বিষয়ক আইন সংস্থা ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইসিই) সংস্থার দুই কর্মচারী তাদের বাবা সাইদ জামালকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছিল। এই ঘটনা প্রায় তিন সপ্তাহ আগের। সাইদ জামালের জন্ম বাংলাদেশে।
১৯৮৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। ৫৫ বছর বয়সী সাইদ স্থানীয় একটি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। তিনি তিন সন্তানের জনক। তারা সবাই আমেরিকান নাগরিক। তাকে দুই সপ্তাহ আগে অভিবাসন বিষয়ক জটিলতায় আইসিই এর লোকজন আটক করে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত তিনি বন্দি রয়েছেন। তার ছেলে তাসিন নিউ ইয়র্কারকে জানায়, ‘আমি খবরে এসব ঘটার কথা শুনেছি। আমি শুধু ভাবিনি যে এমনটা আমাদের সঙ্গেও হবে।’
সাইদ জামাল প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে যান স্টুডেন্ট ভিসায়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে। পড়াশোনা শেষে ক্যানসাস শহরের চিলড্রেন’স মার্সি হাসপাতালে কাজ করার জন্য সেখানেই থেকে যান। সেখান থেকেই তার এইচ-১বি ভিসার স্পন্সর পান। তার শেষ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অন্য কোনো চাকরি খুঁজে না পাওয়ায় সময়মতো নিজের কাগজপত্র নবায়ন করতে পারেননি সাইদ। ২০১২ সাল থেকে তিনি প্রতিনিয়ত আইসিই’র কাছে হাজিরা দিয়ে চলেছেন। এসবের পরেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পেরেছেন শুধু ওবামা প্রশাসনের কারণে। প্রথম কয়েক বছরে কয়কশ’ মানুষকে গ্রেপ্তারের পর ওবামা প্রশাসন অপরাধের রেকর্ড আছে শুধু এমন অভিবাসীদেরই বাইরে পাঠানোর দিকে মনোনিবেশ করে। তবে ট্রামপ প্রশাসনের শুরু থেকে পরস্থিতি পাল্টে যায়। শুরু থেকেই অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর দিকে জোর দেয় এই প্রশাসন। এখন জামালের মতো হাজার হাজার অভিবাসীকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। গত বছর আইসিই ১ লাখ ৪০ হাজার অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করেছে। এর আগের বছরের তুলনায় গত বছর গ্রেপ্তার বৃদ্ধি পায় ৩০ শতাংশ। পাশাপাশি বেড়েছে নন-ক্রিমিনাল (অপরাধের রেকর্ড নেই এমন) গ্রেপ্তারও। আইসিই’র সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান জন স্যান্ডওয়েগ এ বিষয়ে বলেন, ‘আপনি যখন সব অগ্রাধিকার বাদ দিয়ে দেন, তখন আপনি হচ্ছেন একজন জেলের মতো। যেখানে ইচ্ছা সেখানেই আপনার কোটা পাবেন।’ আইসিই’র সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারগুলো কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুসরণ করে না। গত মাসে জর্জ গার্সিয়া নামের এক ফটোগ্রাফারকে মেক্সিকো ফেরত পাঠানো হয়। তিনি ১৯৮৯ সালে বাবা-মা’র সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। এই মাসে এক ৪৩ বছর বয়সী মিশিগান-ভিত্তিক অভিনেতা লুকাসজ নিয়েস’কে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তাকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। তিনি ১৯৭৯ সালে পোল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন।
আইসিই কাকে টার্গেট করবে এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া নেই। ঐতিহাসিকভাবে এই সংস্থার কাজকর্মে সাধারণত হোয়াইট হাউসের প্রভাব থেকে থাকে। সাইদ জামালের গ্রেপ্তার থেকে দেখা যায় যে, আইসিই’র কার্যক্রমে কি পরিমাণ পরিবর্তন ঘটেছে। ২০১০ সালে জামাল তার ভিসা আর নবায়ন করতে পারেননি তখন তাকে আইসিই’র সামনে হাজিরা দিতে বলা হয়। ২০১১ সালের ২৬শে অক্টোবর এক ফেডারেল বিচারক তাকে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু কয়েকদিন পর জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের এক আইনজীবী জামালের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাকে বলেন যে, আইসিই তাকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই বছরের মার্চ মাসে তৎকালীন আইসিই প্রধান জন মর্টন গ্রেপ্তারের জন্য নতুন নির্দেশনা প্রণয়ন করেন। ওই নির্দেশনা অনুসারে, শুধুমাত্র ু জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা ও সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য হুমকিজনক এমন অভিবাসীদের টার্গেট করতে বলা হয়। সাইদ জামাল দুটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছিলেন। তার একটি হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। পাশাপাশি তিনি তিন সন্তানের জনক। জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের ওই আইনজীবীর মতে, শুধুমাত্র এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সুযোগ পান জামাল।
মর্টনের নির্দেশনা অনুসারে, বাকি হাজার হাজার অভিবাসীর মতন জামালও সরকার অনুমোদিত উপায়ে আধা-স্বাভাবিক জীবন যাপন করার সুযোগ পান। প্রতি বছর তাকে বাংলাদেশে ফেরত আসা ঠেকাতে ও কাজ করার অনুমতি পাওয়ার জন্য ৪০০ ডলার পরিশোধ করতে হতো। ২০১৪ সালে তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী জেহ জনসন আইসিই’র জন্য নতুন নির্দেশনা প্রণয়ন করেন। সেগুলোর একটি ছিল- জামালের মতো অভিবাসী যারা যুক্তরাষ্ট্রে বহুদিন ধরে বাস করছেন তাদেরকে ছাড় দেয়া। কিন্তু ট্রামপ ক্ষমতায় আসার পর ওবামা প্রশাসনের প্রণয়ন করা নীতিমালা বাতিল করে দেন। তিনি যথাসম্ভব অভিবাসীকে গ্রেপ্তারের নির্র্দেশ দেন। যার কারণে এখন কাগজপত্র বিহীন যেকোনো অভিবাসীই ঝুঁকির মধ্যে আছেন। জামালের পরিবার এখন তার মামলা লড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে অনলাইনে একটি প্রচারণা শুরু করেছে। তাসিন নিউ ইয়র্কারকে বলেছে, ‘বাবাকে যেদিন গ্রেপ্তার করা হয় সেদিন আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্ন দেখছি। স্কুলে থাকতে ভালো লাগছিল। কেননা, সেখানে থাকলে অন্যকিছু নিয়ে চিন্তা করা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। ক্লাসে মনোযোগ দেয়া কঠিন। আমি সবসময় কি ঘটতে পারে তা নিয়েই চিন্তা করতে থাকি। আসলে, কি ঘটছে তা না জানাটা খুব পীড়াদায়ক।’ বাবার সঙ্গে কয়েকবার ফোনে কথা বলেছে তাসিন। সে বলে, ‘আমার সারাজীবন আমি বাবাকে একজন শক্ত মানুষ হিসেবে দেখে আসছি। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর তিনি যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন মনে হচ্ছিল তিনি ভেঙে পড়ছেন। তিনি যে আসলে দুর্বল হতে পারেন, তিনি যে কাঁদছিলেন এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। আমি তাকে সাহায্য করতে পারিনি।’ গত সপ্তাহে, এক আদালত জামালকে সাময়িকভাবে থাকার অনুমতি দেয়। কিন্তু আদালতের এই অনুমোদন আসার ঠিক আগেই জামালকে মিসৌরি থেকে টেক্সাসের এল পাসোর এক স্থাপনায় স্থানান্তর করা হয়। জামাল পুনরায় তার মামলাটি চালু করার আবেদন করলে সোমবার এক আদালত তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দেয়। এল পাসো থেকে তাকে হাওয়াইতে নিয়ে যাওয়া হয়, ফেরত পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে। ওইদিন, ভিন্ন এক রায়ে বোর্ড অব ইমিগ্রেশন আপিলস, জামালকে আবারো থাকার অনুমতি দেয়। তার আইনজীবীরা এজন্য জরুরি ভিত্তিতে এক পিটিশন দাখিল করেছিলেন। জামালের এক ভাই সাইদ নিউ ইয়র্কারকে বলেন, ‘আমরা জানি না এখন কি ঘটবে। ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রয়েছে। তবে বোর্ড তার ঘটনাটি খতিয়ে দেখার পর পুনরায় তাকে ফেরত পাঠানো হতে পারে।’ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গত মঙ্গলবার আইসিই জানিয়েছে, জামালকে হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের হনোলুলুর এক স্থাপনায় আটক রাখা হয়েছে।
(সম্প্রতি নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে। প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন রিফাত আহমাদ)