রওশন এরশাদের ‘লজ্জা’
দৈনিক সিলেট ডট কম
বাছির জামাল:সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে দেখা যায়, একদিকে যেমন তিনি সত্য উচ্চারণ করেছেন, আবার তেমনি হতাশাও ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, তার দল জাতীয় পার্টি সংসদের প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে থাকতে চায়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারা বিরোধী দলের ভূমিকা রাখতে পারছেন না। বিরোধী দল হিসেবে পরিচয় দিতে তাদের লজ্জা লাগে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে রওশন এরশাদ বলেন, ‘আপনি বলতে পারেন দেশে বিরোধী দল আছে। কিন্তু আমরা পারি না। আমাদের বিরোধী দল হতে দেন, নইলে সবাইরে মন্ত্রী বানাইয়া দেন।’
জাতীয় পার্টি সংসদে সম্মানের সঙ্গে নেই উল্লেখ করে রওশন এরশাদ আরো বলেন, কোথাও গেলে জোর গলায় কথা বলতে পারি না। লজ্জা লাগে। সাংবাদিকদের সঙ্গেও লজ্জায় কথা বলি না। তাদের এড়িয়ে চলি। তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না। আমরা সরকারি দল না বিরোধী দল পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারি না। আপনি বিদেশে গিয়ে কি বলতে পারেন যে দেশে বিরোধী দল আছে? আমিতো দেশে-বিদেশে কোথাও জোর গলায় বলতে পারি না যে, জাতীয় পার্টি বিরোধী দল।
রওশন এরশাদের বক্তব্যের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ থেকে নিজ দলের মন্ত্রীদের বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এ সময় রওশন এরশাদ বলেন, মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে নিয়ে জাপাকে বাঁচান। আর তা না হলে আমাদের সবাইকে মন্ত্রী বানান।
দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদের শেষ দিকে এসে বিরোধী দলীয় নেতা (!) রওশন এরশাদ অবশেষে হৃদয়ঙ্গম করলেন তারা বিরোধী দল নন। সংসদীয় রীতিতে বিরোধী দল যেসব কাজ করে, তার দল জাতীয় পার্টি সে ধরনের কাজ করতে পারছে না। অর্থাৎ বিরোধী দল হিসেবে সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের যে সমালোচনা করার কথা, তা তারা করতে পারছেন না বলেই এক ধরনের ‘অপরাধবোধ’ কাজ করেছে রওশন এরশাদের মধ্যে। ওই বোধ থেকেই তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে এমন সত্য উচ্চারণ করলেন।
এই সংসদ শুরু হওয়ার পর এর প্রথম অধিবেশনের ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সেখানে সংগঠনটি বলেছিল, সংসদের বর্তমান বিরোধী দল আত্মপরিচয় সংকটে ভুগছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের যে মৌলিক চরিত্র হওয়া উচিত তা বর্তমান প্রধান বিরোধী দলের (জাতীয় পার্টি-জাপা) নেই। এখনকার বিরোধী দল একইসঙ্গে সরকারেও আছে, আবার বিরোধী দলেও রয়েছে। সেজন্য যে দলটিকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেটি আত্মপরিচয় সংকটে রয়েছে। বাস্তবে বিরোধী দল বলতে যেটি বুঝায়, সেটির উপস্থিতি বর্তমান সংসদে নেই। হয় সোনার বাটি, না হয় পাথর বাটি হবে; দুটো একসঙ্গে হতে পারে না। এসব বিবেচনায় দশম জাতীয় সংসদ এক ব্যতিক্রমী রূপ ধারণ করেছে, যা অভূতপূর্ব।
বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো এমন একটি সরকার গঠন করা হলো, যেখানে সংসদে নির্বাচিত সবকটি দলের নেতারাই সরকারের অংশ। এমনকি দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে যে দলটি রয়েছে, সেই দলের কয়েকজন নেতা একই সঙ্গে সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থনেই সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ, কিন্তু সেই সরকারে দলটির একজন নেতা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ফলে ওই নেতাকে দলটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে দলীয় সিদ্ধান্তেই বিরোধী দলে থেকে আবার সরকারের অংশ হিসেবে ভূমিকা পালনের মতো দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে এবারই প্রথম।
সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধিতে বিরোধী দলের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, সংসদে সরকারের বাইরে যে সর্ববৃহৎ দল সরকারের বিরোধিতা করবে, সেটিই বিরোধী দল। এখন প্রশ্ন হলো, সরকারে থেকে কিভাবে সরকারের বিরোধিতা করা যাবে? মন্ত্রিসভায় যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরাও তো সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হবেন। তাদেরই একটি অংশ যদি আবার সংসদে এসে তার বিরোধিতা করে, তাহলে তো একই সঙ্গে পক্ষে থাকা বিপক্ষে থাকার মতো উদ্ভট একটা ব্যাপার হবে। আমার জানামতে, সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে অন্য কোনো দেশে এরকম একটা উদ্ভট পরিস্থিতি কখনো তৈরি হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্রের যে রীতিনীতি রয়েছে, সেখানে সরকারের থেকে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করা যায় না। সরকারে অংশ নিলে তারা সরকারেরই অংশ হয়ে যায়। বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা যায় না।
অবশ্য বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের অবস্থান নিয়ে খোদ বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ সংশয়ী হলেও সংসদে তাদের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিএনপির সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি সংসদে ‘গঠনমূলক’ দায়িত্ব পালন করছে।
বিএনপি বর্জনের পর নানা নাটকীয়তার মধ্যে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। রওশন বসেন বিরোধীদলীয় নেতার আসনে। কিন্তু এরই মধ্যে মন্ত্রিসভায়ও যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। সরকারে অংশগ্রহণ থাকায় সংসদে জাতীয় পার্টির কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালন নিয়ে শুরু থেকেই সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছিল। জাতীয় পার্টিকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ও বলে আসছে বিএনপি।
চার বছর পর ২৭ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় দাঁড়িয়ে রওশন এরশাদ অনেকটা আকস্মিকভাবেই সবার মনের কথাটিই বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিরোধী দল হতে পারি নাই। এভাবে বিরোধী দল হওয়া যায়?’ আসলেও তাই। সরকারে অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা যায় না। সংসদীয় সাহিত্যে এ রকম বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই। আমরা ব্রিটিশদের ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতির সংসদীয় গণতন্ত্র অনুসরণ করি। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের মতো ‘সরকারেও আছি, বিরোধী দলেও আছি’ টাইপের বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব নেই। এজন্যই কি না জানি না, অনেক সময় কৌতূহলের সঙ্গে দেখেছি, বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান বা অন্যান্য বিশিষ্ট অতিথি এলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। স্পিকারের সঙ্গে দেখা করেন। সুযোগ পেলে বিএনপিপ্রধানও তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু সংসদে বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে দেখা করেন না বা দেখা দেন না। এসব বিষয় হয়তো রওশন এরশাদকে দহন করছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আসন ভাগাভাগির ভিত্তিতেই যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি হয়েছে, তাই জাতীয় পার্টিকে মন্ত্রিসভায় স্থান না দিয়ে সরকারের উপায় ছিল না। জনাব খান বলছেন, যদি প্রকৃত নির্বাচন হতো, তাহলে নিশ্চয়ই জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে নির্বাচিত হতো না। যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়েছে, তাতে এটি একটি বিচ্যুতি বলা যেতে পারে। নির্বাচন হলে তো বিরোধী দল হবে, এখানে তো আসলে আসন ভাগাভাগি হয়েছে। প্রকৃত অর্থে এখানে কোনো বিরোধী দল নেই।
আকবর আলি খানের মতে, দেশের বেশিরভাগ আসনেই নির্বাচন হয়নি। যেসব আসনে নির্বাচন হয়েছে, সেখানেও সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন হয়েছে। ফলে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আর এর ফলেই জাতীয় পার্টির একই সঙ্গে সরকারি আর বিরোধী দলে থাকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
টিআইবির উপর্যুক্ত রিপোর্ট প্রকাশের দিন সাংবাদিকদের হাসতে হাসতে এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল জানালেন, সংসদ সদস্যদের বলা হয় আইন প্রণেতা, অথচ আইন প্রণয়নে তারা মাত্র দুই শতাংশ (প্রতিবেদন অনুযায়ী কার্যত ১.৮ শতাংশ) সময় ব্যয় করছেন। বাকিটা সময় ব্যয় করছেন নিজেদের স্বার্থে। নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সংসদকে দিয়ে তারা করিয়ে নিচ্ছেন।
আসলে যার যে কাজ তার তাই করা উচিত। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো একে ‘ন্যায়ধর্ম’ বলে অভিহিত করে গেছেন। তৎকালীন প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোয় এ ন্যায়ধর্মের উপস্থিতি ছিল না বলে বেশ পেরেশান ছিলেন প্লেটো। বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদকে ধন্যবাদ- বহুদিন পর বুঝতে পেরেছেন তিনি এবং তার দল সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। অবশ্য রওশন এরশাদের এ বক্তব্য থেকে আমাদের গণতন্ত্রের দৈন্যদশাও ফুটে ওঠছে। এমন উপলব্ধি হওয়ায় রওশন এরশাদ আবারো ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে তার এই উপলব্ধি কী তার দলকে ভবিষ্যতে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী করবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ভবিষ্যতের পানে আপাতত তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই।
বাছির জামাল: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক