সৌদি আরব ও ইরানের সঙ্ঘাত দিয়ে মুসলিম বিশ্বের অবয়ব দেয়ার চেষ্টা
দৈনিক সিলেট ডট কম
ইউসুফ কাপলান: আসুন কিছু ধারণা করি যা আমাদের মনকে উন্মুক্ত করবে এবং কী ঘটছে তা বোঝা সহজ করে দেবে। প্রথমত, মুসলিম বিশ্ব দুই শতাব্দী ধরে একধরনের দাসত্বের মধ্যে রয়েছে; তারা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন নয়। অতএব ইসলামি বিশ্বের আশা তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে একটি যৌথ দুঃসাহসিক পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে অন্তত সংক্ষিপ্ত ও মাঝারি মেয়াদে। ঐতিহাসিক ঘটনা জানা না থাকলে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে এ জ্বলন্ত সত্যটি উপলব্ধি করা যাবে না
গত ২২ এপ্রিল সৌদি আরব ‘তীব্র উত্তেজনা’ সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে হঠাৎ সৌদি আরবে অভ্যুত্থান হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
সত্যিকার অর্থে সৌদি আরবে একটি ‘অভ্যুত্থান’ ঘটতে পারে, কিন্তু সেটি ঘটেছে কিছু সময় আগে। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি শক্তি দেশটির সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে একটি যুতসই অবস্থানে স্থাপন করে।
দেশটির অক্ষে পরিবর্তন আসছে : এটি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসছে আর তা চলে যাচ্ছে ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে।
ব্রিটিশরাও সৌদিদের ‘পরিচালিত’ হিসেবে ব্যবহার করেছে; ইহুদিরাও একই কাজ করতে যাচ্ছে। পরিচালিত হওয়ার ভূমিকা মূলত দেশটির অব্যাহতই থাকবে কিন্তু পরিচালনাকারী পরিবর্তন হবে।
বিন সালমানের আক্রমণাত্মক অবস্থানে উত্তেজনা অনুভবে সতর্ক থাকুন
দুই শতাব্দী আগে, ব্রিটিশরা ওয়াহাবিবাদ আবিষ্কার করেছিলেন। ওয়াহাবিদের অটোমান সাম্রাজ্যকে থামাতে ব্যবহার করা হয়েছিল।
গত ২৫ বছরে নব্য সালাফিবাদের [যার মানে হলো কোনো সালাফ (পূর্বসূরি) নয়] নামে ওয়াহাবিবাদের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তৈরি করা হয়। আর এর পর থেকে তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সন্ত্রাসী সংগঠনকে ব্যবহার করে তুরস্ককে (যেটি প্রধান মুসলিম অভিনেতা হিসেবে আবার এগিয়ে এসেছে) ঠেকানো। সে সাথে ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদকে সংশ্লিষ্ট করা, যা মুসলিম বিশ্বে সৌদি খাওয়ারিজ মানসিকতাকে ছড়িয়ে দেয় এবং এর মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থায় ইসলামের যে আবেদন সেটাকে ব্যর্থ করার প্রয়াস চালানো হয়।
এ প্রক্রিয়াটি অনেকখানি সম্পন্ন করা হয়েছে, কিন্তু এটি সর্বদাই গোপনীয়ভাবে অব্যাহত রাখা হচ্ছে।
এ মুহূর্তে সৌদিরা ‘মধ্যপন্থী ইসলাম’ প্রকল্পে আধিকারিক হিসেবে ইহুদিদের মাধ্যমে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে।
তারা কাজটি করার জন্য ‘মাশরুম’কে (মোহাম্মদ বিন সালমানকে এ নামে ডাকে) দায়িত্ব দিয়েছে।
বিন সালমান প্রথমে জেরুসালেম বিক্রি করেছেন আর এখন তিনি তুরস্ককে থামানোর প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে অবস্থান গ্রহণ করছেন।
বিন সালমান খুবই বিপজ্জনক, নিখুঁত, নিরুদ্বিগ্ন ধরনের মানুষ : তিনি তিন সপ্তাহের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
টাইম ম্যাগাজিন তার তিন সপ্তাহের সফর নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করেছে। টাইমের শিরোনাম দিয়েছে, ‘চার্ম অফেনসিভ’।
প্রচ্ছদ কাহিনীর লেখক কার্ল ভিক নিবন্ধটির জন্য সাবটাইটেল ব্যবহার করেছেন, ‘সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মনে করেন তিনি মধ্যপ্রাচ্যের রূপান্তর ঘটাতে পারেন’।
নিবন্ধটি একটি বাক্য দিয়ে শেষ করা হয়, যাতে বলা হয় : ‘মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কী আছে? জবাব দুটো শব্দ : সৌদি আরব।’
প্রশ্ন হলো সৌদি আরবে এমন কী নতুন রয়েছে?
আন্ডারটেকার বা নেপথ্য পরিচালকের ভূমিকা অবশ্যই সেখানে পরিবর্তিত হয়েছে। টাইমের লেখায় মাশরুমম্যানকে প্রদীপ্ত রঙে রঙিন করা হয়েছে। কিভাবে তিনি মধ্যপন্থী ইসলাম প্রকল্পের জন্য আন্ডারটেকারের ভূমিকা নির্ধারণ করতে যাচ্ছেন সেটি তাতে বলা হয়েছে।
জটিল সমস্যা বোঝার জন্য নির্দেশিকা
যে বিষয়টি এখানে চিহ্নিত করা প্রয়োজন সেটি হলো : ‘মধ্যপ্রাচ্যের’ নতুন কম্পন ও নতুন রূপান্তরের প্রয়োজন।
সেখানে কে কার সাথে নৃত্য করছে এটি হঠাৎ করে বোঝা কঠিন। আর কী ধরনের চুক্তিতে তারা যাচ্ছে সেটি বোঝাও জটিল।
কিন্তু একটি গভীর নিঃশ্বাস গ্রহণ করে একটি নির্দিষ্ট ইতিহাসভিত্তিক দর্শন দিয়ে অবস্থাকে অবলোকন করলে সব কিছু বোঝা সহজ হয়ে যাবে।
আসুন কিছু ধারণা করি যা আমাদের মনকে উন্মুক্ত করবে এবং কী ঘটছে তা বোঝা সহজ করে দেবে।
প্রথমত, মুসলিম বিশ্ব দুই শতাব্দী ধরে একধরনের দাসত্বের মধ্যে রয়েছে; তারা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন নয়। অতএব, ইসলামি বিশ্বের আশা তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে একটি যৌথ দুঃসাহসিক পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে অন্তত সংক্ষিপ্ত ও মাঝারি মেয়াদে। ঐতিহাসিক ঘটনা জানা না থাকলে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে এ জ্বলন্ত সত্যটি উপলব্ধি করা যাবে না।
দ্বিতীয়ত, এ কারণে আমাদের জানার প্রয়োজন রয়েছে যে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম বিশ্বকে আরো কিছু দিন অধীন করে রাখার জন্য নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতে যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, পশ্চিমারা চীন, ভারত ও জাপানকে সব দিক থেকে একই লাইনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু একটি বিভক্ত চেহারা উপস্থাপন সত্ত্বেও তারা ইসলামি বিশ্বের জন্য এ কাজ করতে পারেনি। তারা চীন, ভারত ও জাপানের কনফুসীয়বাদ, তাওবাদ, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও সিন্টোইজমকে সমন্বিত করে একটি আধ্যাত্মিক ভিত্তি গঠন করেছে। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে একই কাজ করতে পারেনি।
চতুর্থত, পশ্চিমারা ভালো করেই জানে যে তুরস্ক সত্যিকার অর্থে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছে এবং একটি সভ্যতার উত্তরাধিকার নিয়ে আবার তার পায়ের ওপর দাঁড়াতে চাইছে।
অতঃপর কিভাবে তারা তুরস্কের যাত্রা বন্ধ করা যায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা সচেতন যে তুরস্কের শক্তি শেলজুক আয়ুবি ও উসমানীয়দের সময়ের মতো মুসলিম বিশ্বকে এক করবে ও নতুনভাবে জাগরিত করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারবে।
এই হলো সেই সত্য যা প্রতি মুহূর্তে আসে
সুন্নি দেশগুলোর দুই প্রধান মেরুদণ্ড হলো পাকিস্তান ও মিসর। এগুলোকে একধরনের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আর তুরস্ককে করে রাখা হয়েছে বিচ্ছিন্ন।
আর এ প্রক্রিয়ার মধ্যে ইরান ও সৌদি আরবকে ক্রমাগতভাবে ধাক্কা দিয়ে মুসলিম বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণে দুই অভিনেতা হিসেবে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
ধারণাটি হলো এ রকম যে, সৌদিরা আহলে সুন্নিদের প্রতিনিধিত্ব করবে আর ইরানের বিরুদ্ধে সৌদিদের কাজে লাগানো হবে।
একটি সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট অপারেশন এখানে চালানো হচ্ছে : ইরানকে এখানে শিকারের অবস্থানে ঠেলে দেয়া হচ্ছে এবং ইরানের জন্য পথ ক্রমাগত আস্তৃত হচ্ছে।
এখানে দুটো লক্ষ্য আছে। প্রথমটি একটি সুন্নি-শিয়া ভুয়া সঙ্ঘাত তৈরি করা এবং এভাবে ইরান যাতে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে তার স্থান করে নিতে সক্ষম হয় এবং এর বৈধতা লাভ করে। ইরানের প্রভাব প্রাথমিকভাবে ইরাকে পরে সিরিয়া, লেবানন, উপসাগরীয় অঞ্চল ও ইয়েমেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, সংক্ষিপ্ত ও মাঝারি মেয়াদে তুর্কিকে নিষ্ক্রিয় করা এবং দীর্ঘ মেয়াদে ইরান ও তুরস্কের মধ্যে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করা।
এর পেছনে লক্ষ্যটি হচ্ছে তুরস্কের উত্থানকে থামানো, যাতে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব একত্র হতে না পারে।
তুরস্ক এ খেলাটি দেখছিল আর রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে কৌশলগত জোট করে এটিকে ব্যর্থ করেছিল।
তবে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে তুরস্ককে নিষ্ক্রিয় করার জন্য আরেকটি প্রস্তুতি নেয়া হয়। তুরস্ক মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে মুসলিম বিশ্বকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য কাজ করেছে। এ কারণে তুরস্কের বিরুদ্ধে আরবদের উসকে দেয়া হয় এবং আরবদের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়।
সংক্ষেপে মুসলিম বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা ইরান, সৌদি আরব ও তুরস্ক নির্ধারণ করবে। আরব বিশ্বের লোকোমোটিভ হিসেবে কাজ করা মিসর সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এই ফ্রেমে নিজেকে আনছে না- অন্তত একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এটি হচ্ছে না। মিসরকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে; এটি এখন নিস্তেজ হয়ে আছে। মিসর নিজেকে নিস্তেজই রাখতে চায় অন্তত যত দিন দৃশ্যত এভাবে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যবস্থার শাসকেরা ইরান ও সৌদি আরব- এই দুই সুপারফিশিয়াল অভিনেতাকে দিয়ে এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগানোর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করতে চায়।
এটি নিছক কোনো ষড়যন্ত্র নয়। তারা সত্যকে বেদনাহত ও দাহ করছে আর আমরা এর মধ্য দিয়েই যাচ্ছি।
আমরাই একমাত্র এসব পরিকল্পনা ধ্বংস করতে পারি। এটি এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে।
কিন্তু ‘আমরা’ কে?
তুরস্ক সেই দেশ যে তার অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ নিয়েছে। তুরস্ক সেই দেশ যে প্রাথমিকভাবে শিক্ষা, মতাদর্শ, শিল্প, সংস্কৃতি, নগরায়ন ও কৌশলÑ সব ক্ষেত্রে প্রতিটি অঞ্চলে সভ্যতাকে জাগিয়ে তুলেছে। তুরস্ক সেই দেশ যে তরঙ্গ ভেঙেছে এবং তরঙ্গ তৈরি করেছে।
অতএব, তুর্কিদের একে অপরের ওপর মনোযোগ দেয়া কেন্দ্রীভূত বন্ধ করতে হবে এবং জ্বলন্ত ইস্যুতে মনোযোগী হতে হবে। ফোকাস করতে হবে, ‘কিভাবে আমরা একসঙ্গে আমাদের সামনে আসা বিপদগুলো দূর করতে পারি।’
তুর্কি দৈনিক ইয়েনি সাফাক থেকে অনুবাদ মাসুমুর রহমান খলিলী