‘রাইপেন’: বাংলাদেশের কল্যাণে প্রবাসীদের মেধা ব্যবহারের অবলম্বন

দৈনিক সিলেট ডট কম
এনআরবি নিউজ, নিউইয়র্ক থেকে : প্রবাসীরা বাংলাদেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতে আগ্রহী। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতা দূরের কথা, বিনিয়োগের আবেদনপত্রও ফাইল চাপা দেয়া হয়। চিকিৎসক, শিক্ষক, আইটি বিশেষজ্ঞরাও বিনা মূল্যে সেবা প্রদানের পরিবেশ খুঁজে পান না। এসব বিষয় গভীর বিশ্লেষণের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের একান্ত আগ্রহে একটি টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছে। ‘রাইপেন’ ( জওচঊঘ)শীর্ষক এ টাস্কফোর্সের কার্যক্রম পরিচালিত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুপারভিশনে। এর প্রধান সমন্বয়কারি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বিষয়ক মূখ্য সমন্বয়কারি আবুল কালাম আজাদ। প্রবাসীদের প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ড. এ কে এ মোমেন। ‘রাইপেন’ টাস্কফোর্সের জন্যে প্রাথমিক বরাদ্দও পাওয়া গেছে।
এই টাস্কফোর্সের সদস্য ড. এ কে এ আব্দুল মোমেন নিউইয়র্কে ‘সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম’র যুক্তরাষ্ট্র শাখা আয়োজিত মতবিনিময় সভায় রাইপেনের প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। গত সোমবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
দীর্ঘ ৩২ বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস-জীবন ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার আহবানে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া অর্থনীতির এমিরিটাস প্রফেসর ড. মোমেন বলেন, ‘রাইপেনের ‘আর’ হচ্ছে রেমিটেন্স, আই-ইনভেস্টমেন্ট তথা বিনিয়োগ, পি-ফিলনথ্রপি তথা সেবামূলক কর্মকান্ড, ই-এক্সপেরিয়েন্স তথা অভিজ্ঞতা এবং এন হচ্ছে নেটওয়ার্ক।
মোমেন উল্লেখ করেন, প্রবাসীরা বিপুল অংকের অর্থ পাঠাচ্ছেন স্বজনের কাছে। কিন্তু সেই অর্থ পরিকল্পিত উপায়ে ব্যয়ের কোন প্রক্রিয়া না থাকায় খাবার, পোশাক, বিলাসিতায় ব্যয় হচ্ছে। নিদেনপক্ষে কেউ কেউ নিজ গ্রামে ছোটখাটো কল-কারখানা অথবা কৃষি জমি কিংবা এপার্টমেন্ট ক্রয় করছেন। অথচ কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় একটি পরিকল্পনা থাকলে রেমিটেন্সের সেই অর্থে গোটা জাতির উন্নয়ন-পরিক্রমা আরো জোরালো হতে পারবে। বিনিয়োগের আকুলতা প্রায় প্রতিটি প্রবাসীরই রয়েছে। অনেকে মোটা অর্থ নিয়ে কল-কারখানা অথবা গরু-ছাগল-মৎস্য উৎপাদনের প্রকল্প জমা দেন। কিন্তু আমলারা সে আবেদন প্রসেসিংয়ে তেমন মনোযোগী হন না। বাস্তবতার আলোকেই সেই প্রবাসীকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরতে হয় আবেদনটি পেন্ডিং রেখেই। এরপর আর সে আবেদন কর্মকর্তার সুনজরে থাকে খুব কম সময়েই অর্থাৎ তা ফাইল চাপা পড়ে যায়। এ অবস্থায় যদি একটি ‘সেল’ থাকে, তাহলে সেই আবেদন ত্বরান্বিত করতে তারা কাজ অব্যাহত রাখবেন। আনুষঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্যে মূল আবেদনকারির সাথে যোগাযোগ করবেন। অর্থাৎ বিনিয়োগের প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে।
ড. মোমেন তার দীর্ঘ প্রবাস-জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাংবাদিক, আইটি বিশেষজ্ঞরা প্রায় বছরই বাংলাদেশে যান। এ সংক্রান্ত একটি ‘সেল’ থাকলে, তার সাথে ঐসব প্রবাসীরা আগে থেকেই যোগাযোগ করে স্বদেশ ভ্রমণের সময় নির্দিষ্ট একটি সময়ে বিনামূল্যে সার্ভিস দিতে পারবেন। এছাড়া, অনেক প্রবাসী নিজ এলাকার হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসা-সরঞ্জাম, স্কুল-কলেজে কম্প্যুটার, বই-পত্র, শীতবস্ত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চালানোর ক্ষেত্রেও ঐ ‘সেল’ সমন্বয়কারির ভ’মিকা পালন করবে। ড. মোমেন উল্লেখ করেন, লন্ডনের একদল প্রবাসী সিলেটের একটি হাসপাতালের জন্যে ১০টি এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সেগুলোর আমদানি-কর রহিত করা হলেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (কাস্টমস) এ্যাম্বুলেন্সগুলো আটকে রেখেছেন। ‘সেল’ থাকলে এহেন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে না সেবামূলক কর্মকান্ডকে।
দীর্ঘদিন বিভিন্ন দফতরে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চান প্রবাসীরা। নিজ দেশের কল্যাণে সকলেই আগ্রহী। ডিজিটাল বাংলাদেশ রচনার ক্ষেত্রেও প্রবাসের আইটি স্পেশালিস্টরা নিজ এলাকায় সুযোগ পেলেই অবদান রাখতে আগ্রহী। কিন্তু সুষম সমন্বয়ের অভাবে সে আগ্রহ মাঠে মারা যাচ্ছে বহু বছর থেকে। অধিকন্তু অনেকে স্বউদ্যোগে কিছু করতে চাইলেও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা পাওয়া যায় না।
নেটওয়ার্কিং এখন এগিয়ে চলার অন্যতম অবলম্বনে পরিণত হয়েছে। প্রবাসীরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নীতি-নির্দ্ধারকদের সাথেও রয়েছে সুসম্পর্ক। এই সম্পর্ক কাজে লাগাতে সরকারের পৃষ্টপোষকতার বিকল্প নেই। সেই দায়িত্বটি পালন করবে সেই টাস্ক ফোর্স-উল্লেখ করেন ড. মোমেন।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমরা শীঘ্রই কাজ শুরু করবো আনুষ্ঠানিকভাবে। এটি প্রবাসীদের উন্নয়নের ধারায় একিভ’ত করতে অবিস্মরণীয় একটি প্ল্যাটফরম হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করছি’-বলেন ড. মোমেন। তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রজন্মের পথ ধরে দ্বিতীয় প্রজন্মকেও জড়িত রাখা সম্ভব হবে। তার অনন্য উদাহরণ প্রতিবেশী ভারত। অসংখ্য ভারতীয় বংশোদ্ভ’ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে ফিরে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য-চাকরি করতে।’ এ প্রসঙ্গে ড. মোমেন বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ‘আইটি সেক্টর এবং গার্মেন্টস সেক্টরের উচ্চতর পদে অধিকাংশরাই ভারতীয়। এটি আমাদের জন্যে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের একটি সংবাদ। আমরা এহেন অবস্থার অবসান ঘটাতে চাই।’
ড. মোমেন উল্লেখ করেন, ‘৩০ ডিসেম্বর ‘প্রবাসী দিবস’ উদযাপন করছি আমরা। এখনও সরকারের অনুমোদন আসেনি। তবে আমরা থেমে যাবো না। এক সময় নিশ্চয়ই সরকার এর স্বীকৃতি দেবেন।’ তিনি আরো বলেন, প্রবাসীদের জন্যে একটি সুখবর রয়েছে যে, দ্বৈত-নাগরিকত্ব বিধির যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা বাতিল হয়ে যাবে। শীঘ্রই জাতীয় সংসদে এ ব্যাপারে একটি বিল উঠবে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন। অর্থাৎ প্রবাসীদের প্রতি শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আন্তরিকতায় কোন কমতি এখন পর্যন্ত ঘটেনি।’
রাইপেন গঠনের প্রত্যাশা পূরণ করতে প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধা এবং একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিতরা একযোগে কাজ করবে বলে এ সময় উল্লেখ করেন উপস্থিত সকলে।
যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ আহমেদ সভাপতিত্ব করেন। নির্বাহী সদস্য মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার স্বাগত বক্তব্য দেয়ার পর পুরো মতবিনিময় অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সেক্রেটারি মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বারি।
বিভিন্ন বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন কন্ঠযোদ্ধা ফকির আলমগীর, রথীন্দ্রনাথ রায় এবং শহীদ হাসান, মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার চুন্নু, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সহ-সভাপতি রফিক আহমেদ এবং হারুন ভ’ইয়া, যুগ্ম সম্পাদক হাজী আব্দুল কাদের মিয়া, মহিলা সম্পাদিকা সবিতা দাস, নির্বাহী সদস্য হাজী জাফরউল্লাহ, মুক্তিযোদ্ধা-সন্তান ফাহাদ সোলায়মান, উইলি নন্দি প্রমুখ। বিশিষ্টজনদের মধ্যে আরো ছিলেন সাপ্তাহিক বর্ণমালা পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি শহিদুল ইসলাম, শো-টাইম মিউজিকের কর্ণধার আলমগীর খান আলম।