‘লাশের’ অপেক্ষায় যে গ্রাম!
দৈনিক সিলেট ডট কম
শুয়াইব হাসান : খুবই বেদনাদায়ক একটি শব্দ ‘লাশ’। আমরা কখনোই প্রত্যশা করি না। আজ এমন একটি গ্রামের কথা বলবো, যে গ্রামের মানুষ কি না লাশের অপেক্ষা করছে! বলতে শুনেছি যে, ‘লাশ’ না পড়লে গ্রামে মানুষ কেউই শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। আশ্চর্য হয়েছি। কিন্তু, কেন?
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ৮নং ঝিংগাবাগী ইউনিয়নের আলোচিত এই গ্রামের নাম ‘নারাইনপুর’। তাদের ঐতিহ্য আছে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এ গ্রামে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিরাজমান। মাঝে ঐক্য ফিরেছিলো। কিন্তু, বর্তমানে গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশুরা এমনভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। এমনকি, রমজানে জানাযার নামাজে গিয়েও দু’পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়েছে। আনন্দ-উৎসবের দিনেও ঘটেছে হামলার ঘটনা। হাওরে মাছ শিকারেও এ রেশ ছাড়েনি। রেশারেশির শিকার হয়েছে অবুঝ গরু-মহিষও। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঘরবাড়ি। ১০ হাজার জনসংখ্যার এ গ্রামের নারী ও শিশুরা রাতে প্রাকৃতিক প্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হতে চায় না, আতংক কাজ করে। সন্ধ্যার পর গ্রামে প্রবেশে বাইরের যে কেউ, এমনকি আইনশৃংখলা বাহিনী নাকি ভয় পায়? দিনের বেলা গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতেও চায় না। পরিবারের কড়াকড়িতে অনিশ্চিত যাত্রায় পা বাড়ায় শিশুরা। অনেকে নাকি জীবনঝুঁকিতে উঠতি যুবকদের কলেজে পড়া গোল্লায় দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
এ থেকে অনুমান করা যায়, নিশ্চিত লাশের পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নারাইনপুর গ্রাম। আগামী ঈদ-উল-ফিতরের দিন ঈদগাহে আনন্দের পরিবর্তে বেদনার এ অপ্রত্যাশিত ‘শব্দ’ অপেক্ষা করছে কি-না। গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের শিশু-সন্তানদের ঈদগাহের পরিবর্তে আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন।
গ্রামের অনেকের সাথে কথা হয়েছে। নারাইনপুর গ্রামের গল্প-আড্ডার কেন্দ্র পাশ্ববর্তী বিশাল বাজার গাছবাড়ী। সেখানেও কারো তেমন দেখা মেলে না। শিক্ষিত যুবকরা গ্রামের এ পরিস্থিতির কারণে হতাশ হয়ে পড়েছেন। তারা একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও সুরাহা করতে পারেননি। গ্রামের বাইরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ব্যর্থ হয়েছেন।
সপ্তাহদিন আগে নারাইনপুর গ্রামের যুবক ফারুকের (ছদ্দনাম) সাথে দেখা হল। গ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন সে। বাড়ি ছাড়া ফারুক। বললো বিস্তারিত। কথার মধ্যে আতংকের ছাপ। জিজ্ঞেস করলাম- দুই পক্ষকে সমঝোতায় পৌঁছানোর উদ্যোগ কি কেউ নেয়নি?
‘নিয়েছেন। সবাই ব্যর্থ হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীও উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। গ্রামের শিক্ষিত যুবক, স্কুল-মাদরাসার শিক্ষক, অন্যান্য চাকুরিজীবীরা সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এক পক্ষ রাজি হলে অন্য পক্ষ হয় না। তারাও ব্যর্থ হয়েছেন।’- বলতে বলতে ফারুকের হৃদপিন্ডের কম্পন বেড়ে গেলো। কথার মধ্যে আমাকে প্রশ্ন করলো- ভাই, আপনি আবার আমাকে বিপদে ফেলেন না প্লিজ। আশ্বস্ত করলাম, বললাম- হে যুবক, ভয় পেয়ো না। তোমার গ্রাম নিয়ে আরো অনেকে উদ্বিগ্ন। অনেকে আমাকে এসব খবর দিয়েছেন। ফারুকও একটি পক্ষে আছে। কিন্তু,এ ধরণের দ্বন্দ্ব-বিবাদ-হানাহানি সে মন থেকে চায় না।
হ্যা, শুধু ফারুকই আমাকে এ খবর দেয়নি। ওই গ্রামের কয়েক নারী-শিশুর সাথেও কথা হলো। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে দিনাতিপাত করছেন সবাই। সেদিন সংঘর্ষের খবর জানাতে এক কিশোর আমাকে টেলিফোন করে বলল- প্লিজ, তাড়াতাড়ি পুলিশ পাঠান। শুধু এ গ্রামের মানুষ আমাকে বলেনি, বলেছেন অনেকে। কানাইঘাট এবং সিলেট শহরে বসবাসকারী এ অঞ্চলের মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে নারাইনপুর গ্রাম।
কয়েক বছর আগে নাকি এ গ্রামে দুই পক্ষের বিরোধ জমাট বেঁধে ‘ডাবল লাশে’ রূপ নিয়েছিলো। সে অতীতের কী পুনরাবৃত্তি ঘটবে আবারো? এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
আইনশৃংখলা বাহিনীও নাকি এ বিষয়ে ব্যর্থ? দুই পক্ষের মারামারির পর কয়েকটি মামলাও হয়েছে। কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করিনি। মাস-দিন আগে যখন খবর পেলাম নারাইনপুর গ্রামে হানা দিয়েছে পুলিশ। কিছুটা নিশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম, অবশেষে একটা উদ্যোগ হলো, হয়তো মুক্তিপাবে এ গ্রামের নারী-শিশু। কিন্তু, সকালের হালকা মন আবারো ভারি হয়ে উঠল যখন খবর পেলাম- পুলিশের অভিযানে হাওরের দিকে পালিয়ে যাওয়া দুই পক্ষই মারামারিতে জড়িয়েছে।
সেদিন জেলা পুলিশের ইফতারে গিয়েছিলাম। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমার পাশে বসে ইফতার করছিলেন। ইফতার মুখে নিতে নিতে এএসপি মহোদয়কে নারাইনপুর গ্রাম সম্পর্কে বললাম। তিনি রমজানের আগে যে অভিযান হয়েছিল সেদিন নিজেই ছিলেন। কিছুটা ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেলে তার কথায়। ‘গ্রামের লোকজন টাকা পয়সা নিয়ে মারামারি করবে, কারো কথা শুনবে না, তাতে আমাদের কী করণীয়। কয়েকজনকে ধরে নিয়ে এলাম- তবুও ওরা নিজেদের চরিত্র বদলায়নি।’- ক্ষোভ ঝেড়ে কথাগুলো বলে গেলেন তিনি। পরে অবশ্য অফিসে দাওয়াত দিয়ে বললেন, বিষয়টি নিয়ে এখানে আলোচনা তো সম্ভব না। একদিন আসুন। কথা বলবো।
নারাইনপুর একটি বিশাল গ্রাম। একপ্রান্তে প্রবেশ, আবার একই পথে ফেরা। ২০ থেকে ২৫টি সংযোগ সেতু রয়েছে গ্রামের মধ্য দিয়ে বহমান বিশাল খালের ওপর। কেউ ভেতরের দিকে গেলে ওরা নাকি মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে যায়। পথ আটকে দেয়। অবশ্য, ডাকাত-চোর সাহস করে এ গ্রামে প্রবেশ করে না তাদের এমন ঐতিহ্যের কারণে। ঐক্য ছিল, লোকসংখ্যাও কম নয়। লোকসংখ্যা আধিক্যতার কারণে একই গ্রামে অন্তত ৭টি মসজিদ নির্মাণ করতে হয়েছে।
কিন্তু, সে ঐক্য নষ্ট হলো কেন? অর্থ নাকি ঐক্য বিনষ্টের মূল কারণ। আর আধিপত্য দেখানোকে কেন্দ্র করে সাবেক ইউপি সদস্য আজির উদ্দিন (আজই মেম্বার) ও শরিফ উদ্দিনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর আগে ওলিউর রহমান ও আরেক আজির উদ্দিন দ্বন্দ্বে একজন প্রবাসীসহ জোড়া লাশ পড়লো। তারপর থেকে দু’পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছালো। এর আগে সে সুরাহা হয়নি অনেক চেষ্টার পরও। অবশ্য, তাবলীগ জামায়াতের সাবেক আমীর মাওলানা হরমুজ উল্লাহ (রহ.) এ গ্রামের কৃতি সন্তান ছিলেন। তিনি একাধিকবার গ্রামের দ্বন্দ্ব মিমাংসা করে দিয়েছেন। কোন বিষয়ে সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব না হলে একমাত্র অবলম্বন ছিলেন এই বুজুর্গ। তিনি আজ আর নেই। দীর্ঘদিন ধরে নারাইনপুর গ্রামের এ ভয়ংকর পরিস্থিতি প্রশমনে এখন কে হবেন উদ্যোগী?
কাউকে উদ্যোগী হতে হবে। অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বিপথে যাবে। সামাজিক বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়বে স্তরে স্তরে। আর এ থেকে সুবিধা নেবে এক শ্রেণির স্বার্থভোগী।
লেখক : সংবাদকর্মী