নিউইয়র্কে ৩ দিনের বইমেলা শুরু
দৈনিক সিলেট ডট কম
এনআরবি নিউজ, নিউইয়র্ক থেকে: ‘বহুজাতিক এ সমাজে বেড়ে উঠা প্রজন্মে বাঙালি সংস্কৃতি জাগ্রত রাখার চলমান কার্যক্রম জোরদারের জন্যে বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। বইমেলাকে আরো উদ্দীপ্ত রাখতে প্রবাস প্রজন্মের উপযোগী গল্প-কবিতা-উপন্যাস এবং গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ করতে হবে। আর দায়িত্বটি নিতে হবে দেশ ও প্রবাসের খ্যাতিমান লেখক-সাহিত্যিকদেরকেই’-এমন অভিব্যক্তি প্রকাশের মধ্য দিয়েই ২২ জুন শুক্রবার অপরাহ্নে নিউইয়র্কে শুরু হলো ‘২৭তম নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলা’। বাংলাদেশ এবং আমেরিকার জাতীয় পতাকা নিয়ে অংশ্রহণকারি বরেণ্য শিল্পী-সাহিত্যিক-সমাজকর্মী-সাংস্কৃতিক সংগঠকরা র্যালির পর ফিতা কেটে ও বেলুন উড়িয়ে শুরু এই বইমেলায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ রচনার চলমান কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার সংকল্পও ব্যক্ত করা হয়।
উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশীদের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে বেলাজিনো পার্টি হল প্রাঙ্গনে এই মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। এরপরই বেলাজিনোর সুপরিসর মিলনায়তনে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন ২৭ জন লেখক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। এরা হলেন রামেন্দু মজুমদার, শামসুজ্জামান খান, আনোয়ারা সৈয়দা হক, নূরন্নবী, জামালউদ্দিন হোসেন, সাইফ ইমাম জামি, আনিসুল হক, আমিরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন, নাজমুন্নেসা পিয়ারি, ফেরদৌস সাজেদীন, নিনি ওয়াহেদ, জসীম মল্লিক, সৌরভ শিকদার, সৈয়দ আল ফারুক, পারমিতা হিম, ইফতেখারুল ইসলাম, নাসরিন জেবীন, রুমা মোদক, রিফাত কামাল সাইফ, আব্দুন নূর, সালেহা চৌধুরী, গীতালী হাসান প্রমুখ।
দ্বিতীয় পর্বের প্রদীপ প্রজ্জ্বলনে অংশ নেন প্রকাশক ফরিদ আহমেদ, আরিফ হোসেন ছোটন, মনিরুল হক, শ্যামল পাল, মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন, আহমেদ মাহমুদুল হক, আবুল হাসনাত, জাফর আহমেদ রাশেদ, মেজবাহউদ্দিন আহমেদ, আলমগীর শিকদার লোটন, আবুল বাশার ফিরোজ, তারিকুল ইসলাম রনি, জহিরুল আবেদীন জুয়েল, রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল, মাহমুদুল হাসান মানিক, আলপনা হাবিব, বাবুল বিশ্বাস, মোশারফ হোসেন।
এ সময় মূলমঞ্চে সেমন্তী ওয়াহেদের পরিচালনায় প্রবাস প্রজন্মের অংশগ্রহণে ‘যদি বন্ধু হও’ অনুষ্ঠানে অংশ নেয় ময়ুরী, চন্দ্রিমা, মাইশা, সুস্বনা, দ্যুতি, উদিতা, অধরা, অনিকা, রেহা, অন্তরা, শ্রাবণী, মৌমি।
‘আগামী’ শীর্ষক আরেকটি পরিবেশনায় অংশ নেয় প্রবাস প্রজন্ম। আর এভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির সাথে আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারি বাঙালি প্রজন্মকে জড়িয়ে রাখার নিরন্তর একটি প্রয়াসের বহি:প্রকাশ ঘটে ২৬ বছর বয়েসী এই বইমেলায়।
নিউইয়র্কস্থ মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের এই বইমেলা আয়োজনে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিদিন-উত্তর আমেরিকা সংস্করণ, চ্যানেল আই, প্রথম আলো এবং প্রবাসের খ্যাতনামা রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
মেলা কমিটির আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা-লেখক ড. নূরন্নবী বলেছেন, সবকিছু মিলিয়ে ২৬ বছরের ব্যবধানে নিউইয়র্কের এই বইমেলা পরিণত হয়েছে প্রবাসে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালিদের মিলনমেলায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের বাইরে এই বইমেলা সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তর। প্রতিবছরই মেলায় যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। দু’বছর আগে শুরু হয় ‘মুক্তধারা-চ্যানেল আইন সাহিত্য পুরস্কার।’ প্রথম পুরস্কার পান কবি নির্মলেন্দু গুণ। গত বছরের পুরস্কার পেয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।
ড. নবী উল্লেখ করেন, এবার ২৭তম বইমেলা থেকে সাহিত্য পুরস্কারের নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘মুক্তধারা-জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার।’ এ বছর আরেকটি নতৃুন পুরস্কার প্রবর্তণ করা হয়েছে ‘মুক্তধারা-কথাপ্রকাশ চিত্তরঞ্জন সাহা সাহিত্য পুরস্কার।’
লেখক ফেরদৌস সাজেদীন বলেন, ‘আজ বিশ্বজোড়া জাগরণের গানে মিশে আছে বাংলাদেশীর স্বর ও সুর। কান পেতে শুনি বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশীর জীবন-ধ্বনির জয়গান। যে জীবন নিজ দেশে পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল, সে জীবন পৃথিবীর অচেনা লোকালয়ে ছিটকে পড়ে হতবাক হলেও প্রতিভাসে জয়ী। বাংলাদেশের বাইরে শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, বাণিজ্যের অগ্রযাত্রা আজ আর কোন ধেবক্রম নয়-মেধা, শ্রম, ঘাম সমন্বয়ে অর্জিত ফসল সব। এটা অনুমান করা যেতে পারে যে, অন্তত আমাদের শহরে আজ সমষ্টি-নি:সঙ্গতা বিরল হয়েছে। পরিবর্তে আপন সংস্কৃতির একটি উত্তাল সময়ের মধ্যে অভিবাসী বাংলাদেশী তার জীবনকে অতিবাহিত হতে দেখছে। তার অগ্রগামিতা নিকটকালে থেমে যাবে না, বরং গতিপ্রাপ্ত হবে। আর তার স্বরূপটি উদঘাটন করবে ইতিহাস, এখন যা আমরা বপন করছি।’
‘বই হোক আমাদের উত্তরাধিকার’ স্লোগানে এই মেলার পরবর্তী দুদিন অর্থাৎ ২৩ ও ২৪ জুন শনি ও রোববার সকাল ১১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলবে পিএস-৬৯ (৭৭ ষ্ট্রিট ও ৩৭ এভিনিউউ, জ্যাকসন হাইটস) স্কুল মিলনায়তনে। বইয়ের পাশাপাশি থাকবে বাঙালি ঐতিহ্যের পরিপূরক খাদ্য-পণ্যের স্টল।
বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বাইরে বৃহত্তম ও সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এই বাংলা বইমেলায় উত্তর আমেরিকার শতাধিক লেখক অংশ নিচ্ছেন।
মেলায় সংগীত পরিবেশন করছেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী লিলি ইসলাম, আধুনিক বাংলা গানের জনপ্রিয় শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। ফিলাডেলফিয়া থেকে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কাদেরী কিবরিয়া। এছাড়া কন্ঠযোদ্ধা শহীদ হাসান, ড. তনিমা হাদী, জীবন বিশ্বাস, নাহিদ নাজিয়া, শবনম আবেদী, শান্তা নাগ, নীপা ভৌমিক, ফাহমিদা শারিমন, রুবিনা শিল্পী, শাহ মাহবুব ও কৃষ্ণা তিথীও বিভিন্ন পর্বে গান গাইছেন।
বাংলা একাডেমি, প্রথমাসহ বাংলাদেশের ২০টির মতো প্রকাশনা সংস্থা মেলায় নতুন বইয়ের প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমদ ও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন মেলায় লেখক-পাঠকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের রেকর্ডসংখ্যক প্রকাশক অংশ নিচ্ছেন এ বইমেলায়। রয়েছেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির সভাপতি ও সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদ, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির নির্বাহী পরিচালক ও অনন্যা প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী মনিরুল হক, আহমেদ, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি পুথিনিলয়ের স্বত্বাধিকারী শ্যামল পাল, নিউইয়র্ক বইমেলা কর্তৃক ঘোষিত চিত্তরঞ্জন সাহা প্রকাশনা পুরস্কার-এর সহযোগী ও কথাপ্রকাশ এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, মাওলা ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আহমেদ মাহমুদুল হক, কালি ও কলম সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ও বেঙ্গল প্রকাশনের নির্বাহী আবুল হাসনাত, প্রথমা প্রকাশনের নির্বাহী জাফর আহমেদ রাশেদ। আরো আছেন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির পরিচালক ধ্রুবপদের স্বত্বাধিকারী এম ডি আবুল বাশার ফিরোজ শেখ, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির পরিচালক ও তাম্রলিপি প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী এ কে এম তরিকুল ইসলাম রনি, গতিধারা প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী এমডি আবুল বাশার শিকদার, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির প্রাক্তণ সভাপতি ও আকাশ প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী আলমগীর শিকদার লোটন, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ পরিচালক জহিরুল আবেদীন জুয়েল, নালন্দা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল , থিয়েটার, বাবুল বিশ্বাস, গণ প্রকাশন-মাহমুদুর হাসান মানিক ও আলপনার রান্নাঘর-এর আলপনা হাবিব।
উত্তর আমেরিকা থেকে বই বিক্রেতা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মুক্তধারা নিউইয়র্ক, ঘুংঘুর, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন নিউইয়র্ক, ইসলাম ইন্টারন্যাশনাল পাবলিকেশন্স, গ্লোবাল বাংলা মিশন, সৃজনকাল ও বাংলা গবেষণা, পঞ্চায়েত প্রকাশনী, লুৎফুর রহমান বিনু ও ঊনবাংলা ।
এবছরই প্রথমবারের মত ২৮টি বইয়ের স্টল হচ্ছে নিউইয়র্ক বইমেলায়। ইতিপূর্বে কখনো এত বইয়ের স্টল হয়নি। বইয়ের স্টল ছাড়াও বাংলাদেশের শুকনো খাদ্য সংস্থা বেঙ্গল বিস্কিটস লিমিটেড, কোলকাতা থেকে তিয়ারা বুটিক, ক্লাসিক বুটিক, ফ্লোরিডা থেকে লিয়া শাড়ী, নিউইয়র্ক থেকে বিভা বুটিক, সায়ীদা কালেকশন্স, পিয়াল কালেকশন্স অংশগ্রহণ করছে।
অনুষ্ঠানমালায় আরো রয়েছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের স্মরণে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘জননী’। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঢাকায় একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে যে গণ-আদালত বসে, তাতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী টমাস কিটিং। এই মেলায় কিটিংকে তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হবে শনিবার রাতের অনুষ্ঠানে।
মেলার অন্যান্য পর্বে রয়েছে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে আলাপচারিতা, ‘লেখক বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক আলোচনা ও ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে মতবিনিময়। প্রয়াত কবি রফিক আজাদ ও সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতির উদ্দেশে থাকবে শ্রদ্ধাঞ্জলি। এতে অংশ নেবেন কবিপতœী দিলারা হাফিজ ও আনোয়ারা সৈয়দ হক।
প্রতিবছরের মতো এবারেও থাকবে প্রবাসী শিল্পীদের গান, কবিদের কবিতাপাঠ ও তাঁদের রচিত গ্রন্থের ওপর আলোচনা। উল্লেখ্য, এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালি লেখকদের দেড় শর মতো নানা স্বাদের বাংলা বই প্রকাশিত হয়েছে। এবছর মেলার মূল মিলনায়তনের নাম রাখা হয়েছে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মিলনায়তন। বইমেলার প্রাঙ্গণের নাম রাখা হয়েছে শওকত আলী প্রাঙ্গণ। সেমিনার কক্ষের নাম রাখা হয়েছে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম কক্ষ।