আমেরিকানদের হৃদয়ও জয় করলেন বাঙালি শিল্পী কৃষ্ণা তিথি
দৈনিক সিলেট ডট কম
এনআরবি নিউজ, নিউইয়র্ক থেকে: গানের পরশে বাঙালির হৃদয় জয়ের পর মার্কিনীরাও অভিভ’ত কৃষ্ণা তিথির সঙ্গীতে। চ্যানেল আই-এর সেরাকন্ঠি এবং সেরাদের মধ্যেও সেরা খেতাবধারী কৃষ্ণা তিথি নিউইয়র্ক স্টেট এ্যাসেম্বলী, স্টেট সিনেট, সিটি কাউন্সিলের সম্মাননা স্মারক লাভ করলেন। আর এভাবেই বাঙালি শিল্পী তার জাদুকরী কন্ঠের মোহনায় ভাসিয়ে নিচ্ছেন আমেরিকানদেরকেও। ক্ইুন্স এবং ব্রঙ্কসের হাজার হাজার মানুষের বিপুল করতালির মধ্যে সম্প্রতি তাকে এসব সম্মাননা সনদ হস্তান্তর করা হয়।
ভাল এবং বড় অনুষ্ঠান মানেই কৃষ্ণা তিথি। কারণ, সকল বয়েসী শ্রোতার মনোরঞ্জনে পারদর্শী তিনি। মিষ্টি মেয়ের প্রতিক। পরিবেশনাতেও থাকে শালিনতা। গানে গানে হারিয়ে গেলেও নিজের ব্যক্তিত্ব তলিয়ে যায় না এই শিল্পীর। মঞ্চের মত ব্যক্তি জীবনেও বিশেষ এক স্বাতন্ত্র পরিলক্ষিত হয়-যা জনপ্রিয় সকলের থাকে।
গোপালগঞ্জে সঙ্গীত পরিবারের সন্তান কৃষ্ণা তিথি শিশুকালেই সঙ্গীতে নামেন। তামিল নেন ছায়ানট এবং জাতীয় নজরুল একাডেমি থেকে। শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চায় মনোনিবেশ করেন লেখাপড়ার পাশাপাশি। সেই থেকে আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে তার উত্থান ঘটে। জনপ্রিয়তার এ মাত্রা ছড়িয়ে পড়েছে আটলান্টিকের উভয় পাড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে কৃষ্ণা তিথির কথা বলাবলি হয়। তবে কৃষ্ণা প্রেমে পড়েছেন মার্কিন প্রবাসীদের। এজন্যে নিউইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া-ফ্লোরিডা-জর্জিয়া-মিশিগান-পেনসিলভেনিয়া-বস্টন-মেট্র ওয়াশিংটন প্রভৃতি স্থানে আমন্ত্রণ পেলেই ছুটে যান এই শিল্পী।
প্রবীন এক সাংস্কৃতিক সংগঠকের মতে, একজন জাত শিল্পীর যেসব গুণাবলি থাকার কথা সবই আছে কৃষ্ণা তিথির। বলাল অপেক্ষা রাখে না, নতুন প্রজন্মের শিল্পীর কেউ কেউ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হঠাৎ করেই দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছেন, দেশে- বিদেশে শো করছেন, আবার হারিয়েও যাচ্ছেন। হারিয়ে যাবার কারণও অনেক। বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল গ্রামগঞ্জ এবং শহর থেকে যে সব প্রতিভাকে তুলে নিয়ে আসে, প্রতিযোগিতা শেষে তাদের ঠিকমত পরিচর্যা করা হয় না। তুলে এনে সস্তা জনপ্রিয়তায় শিল্পী খেতাব দিয়েই তাদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। অনেকেই হঠাৎ করে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা পেয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করে ভিন্ন পথে চলে যান। বাস্তব নির্মমতায় তারা হারিয়ে যেতে বাধ্য হন। তবে হারিয়ে যাননি কৃষ্ণা তিথি। চ্যানেল আই’র সেরা কন্ঠে চতুর্থ হয়েও কৃষ্ণা তিথির হারিয়ে না যাবার কারণ হচ্ছে, তিনি একজন আপাদমস্তক শিল্পী। শিল্পী স্বত্তা তার রক্তের মধ্যেই রয়েছে। বাবা তাপস কুমার খাঁ রেডিও বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন তালিকাভুক্ত শিল্পী। পেশায় ব্যাংকার হলেও ছোট বেলা থেকেই তাপস গান করতেন। একসময় বাংলাদেশের নামকরা শিল্পী ছিলেন তিনি। সেই শিল্পীর রক্তই ধমনিতে বহন করছেন কৃষ্ণা তিথি।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে জন্ম নেয়া কৃষ্ণা তিথি মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সেই গান শুরু করেন। তাও আবার মঞ্চে। বাবা সরকারি চাকরি করার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে গান করেছেন তিনি। কৃষ্ণা তিথির মা নীভারাণী খাঁ ছাড়া সবাই শিল্প- সংস্কৃতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। বড় বোন পল্লবী খাঁও একজন শিল্পী, ভাই আশীষ খাঁ তবলা বাদক। বোন পল্লবী বাবা তাপস কুমার খাঁর একটি স্বপ্ন পূরণ করেছেন। বাবার মতই তিনি ব্যাংকে চাকরি করেন। ভাই আশীষ এখন ব্যবসা করেন। বাবার আরেকটি স্বপ্ন পূরণ করছেন শিল্পী কৃষ্ণা তিথি। বাবার সুরকে নিজেই লালন করছেন। শিল্পী কৃষ্ণা তিথির গানে হাতেখড়ি বাবা তাপস কুমারের কাছেই।
জীবনে প্রথম মঞ্চে গান গেয়েছেন শরিয়তপুর পাবলিক স্কুলের এক অনুষ্ঠানে। কৃষ্ণা তিথি বলেন, বড় বোন গান করছিলো। ঐ গানের সময়ই আমি বাবা-মার সাথে অডিয়েন্সে মার কোলে বসেছিলাম। মনের অজান্তেই আমিও গান শুরু করি। আমার বাবা আমাকে টেবিলের উপরে দাঁড় করিয়ে দিলেন, আমি সেখানে দাঁড়িয়েই গান করি। গানটি ছিলো দেশাত্মবোধক। বাবা ছাড়াও কৃষ্ণা তিথির ওস্তাদ ছিলেন জাকির হোসেন খাঁ।
ছোট বেলা থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন শিল্পী কৃষ্ণা তিথি। পুরস্কারও পেয়েছেন অসংখ্য। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪টি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রতিটিতেই পুরস্কার পেয়েছেন। চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন। পুরস্কার পেয়েছেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতায়।
শিল্পী স্বত্তার পাশাপাশি লেখাপড়া করে যাচ্ছেন কৃষ্ণা তিথি। ঢাকার ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি, ভিখারুননেসানূন স্কুল থেকে এইচএসসি, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ, ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ পাস করে স্কালারশিপ নিয়ে আমেরিকায় এসেছেন। আমেরিকার এই কষ্টের জীবনের মধ্যেও কানেকটিকাটের ব্রিজপোর্ট ইউনিভার্সিটি থেকেই এমবিএ করেন। শিল্পী কৃষ্ণা তিথি লেখাপড়া সম্পন্ন করতেই ইউনিভার্সিটিতে খন্ডকালীন চাকরি করেছেন। সেই সাথে রক্তে বহমান সঙ্গীতের রক্ত চলমান রাখতেই আমেরিকার ১৮টি স্টেটে গান করেছেন। এখনো গান করছেন। শিল্পী কৃষ্ণা তিথির সঙ্গীতে যেমন যাদুর কণ্ঠ, কথাও বলেন যাদুর মত সুন্দর করে।
কৃষ্ণা তিথি বলেন, ফোবানা, ঢালিউডসহ অনেক বড় বড় অনুষ্ঠানে গান করেছি। তবে আমেরিকার চেয়ে দেশই ভাল লাগে। প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে প্রচন্ড ভালবাসি এবং মিস করি। তবে আমেরিকায় যে সব প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন তাদের দেশপ্রেম ও শিল্পীর প্রতি যে ভালবাসা তার তুলনা চলে না। বাংলাদেশেও এখন প্রতিটি জেলায় গানের অনুষ্ঠান হয় না, কিন্তু প্রবাসে ৬৪টি জেলার মানুষই গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বিপাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা আমাদের শিল্প- সংস্কৃতিকে লালন করছেন, প্রবাসে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের শিশু- কিশোরদের মধ্যে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের সংস্কৃতির বীজ বুনে দিচ্ছেন- এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? এখানে গানের অনুষ্ঠানে গেলে মনে হয় যেন বাংলাদেশেই আছি।
কৃষ্ণা তিথির মতে, এখানে প্রবাসীরা বাংলা সংস্কৃতিকে অন্তরে সব সময় লালন করেন। ব্রঙ্কসে একটি অনুষ্ঠানে গান করছিলাম। এক পর্যায়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা আমার গানে আপ্লুত হয়ে বললেন, মা তুমি আরেকটি দেশাত্মবোধক গান কর। এমন ভালবাসা কোথায় পাবো? আমার এক ভক্ত একদিন এক অনুষ্ঠানের ড্রেসিং রুমে এসে বললেন, আপু আমি আপনার সব গানই শুনেছি, প্রবাসে কোন অনুষ্ঠানে আপনার নাম দেখলে আমি চলে আসি। এই ভালবাসা বাঙালিই দিতে জানে। আপন করে নিতে বাঙালিই জানে।