ভারত: ভয়ঙ্কর গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচনী মৌসুম
দৈনিক সিলেট ডট কম
অরুন্ধতী রায়:ভারতের ৩০ আগস্টের খবরের কাগজগুলো অনেক দিনের এক বিতর্কের মীমাংসা করে দিল। পাঁচজন রাজনৈতিককর্মী গ্রেপ্তারের ব্যাপারে প্রথম পাতায় এক প্রতিবেদনে দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাটি লিখেছে, ‘আটককৃতরা সরকার উচ্ছেদে ফ্যাসিস্টবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ, আদালতকে জানাল পুনে পুলিশ।’
এর মাধ্যমে জানা গেল, আমরা এমন এক ধরনের শাসন মোকাবিলা করছি যাকে তার নিজস্ব পুলিশও ফ্যাসিস্ট বলে আখ্যায়িত করে। আজকের ইন্ডিয়ায় কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীভুক্ত হওয়াটাই অপরাধ। খুন হয়ে মরে যাওয়াও অপরাধ। গণপিটুনিতে মারা যাওয়াও অপরাধ। গরিব হওয়াও অপরাধ। গরিবের পক্ষে কাজ করতে যাওয়া মানে সরকার উচ্ছেদে ষড়যন্ত্র করা।
মহারাষ্ট্র রাজ্য পুলিশ যখন দেশজুড়ে একযোগে বহু রাজনৈতিককর্মী, কবি, আইনজীবী ও ধর্মযাজকের বাসায় অভিযান চালাল আর উদ্ভট অভিযোগ এনে যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করল যাদের তিনজন নামকরা নাগরিক অধিকারকর্মী ও দুজন আইনজীবীÑ তখন সরকার নিশ্চয় জানত এর মাধ্যমে তারা বিক্ষোভ উসকে দিচ্ছে। এই পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সরকার আমাদের সম্ভাব্য সব ধরনের প্রতিক্রিয়া নিশ্চয় বিবেচনায় নিয়েছে, সারাদেশে যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা গেল তাও হয়তো তাদের ভাবনায় ছিল। তার পরও কেন তারা এমনটা করল?
প্রকৃত ভোটার ড্যাটার সা¤প্রতিক বিশ্লেষণগুলোয় এবং লোকনীতি-সিএসডিএস-এবিপি মুড অব দ্য নেশন জরিপে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি [তাদের জন্য] বিস্ময়কর দ্রæত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন। তার মানে, আমরা ভয়ঙ্কর সময়ের দিকে যাত্রা করছি। এই জনপ্রিয়তা হারানোর কারণগুলো থেকে আমাদের দৃষ্টি ভিন্নদিকে সরিয়ে রাখা এবং বিরোধী পক্ষের ক্রমবর্ধমান সংহতিতে ভাঙন ধরানোর জন্য নিদারুণ ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা নেওয়া হবে।
এখন থেকে আগামী বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত গ্রেপ্তার, গুপ্তহত্যা, গণপিটুনিতে মৃত্যু, বোমা হামলা, ‘ফলস ফ্যাগ’ হামলা, দাঙ্গা, সা¤প্রদায়িক নিধনযজ্ঞের অবিরাম সার্কাস চলতে থাকবে। নির্বাচনী মৌসুমের সঙ্গে আমরা সব ধরনের সহিংসতার প্রাদুর্ভাবের যোগসূত্র স্থাপন করতে শিখেছি। বিভক্ত করে শাসন করার পুরনো তরিকা তো আছেই, তার সঙ্গে এবার যুক্ত হলো দৃষ্টি ভিন্নদিকে সরিয়ে দিয়ে শাসন করা। এখন থেকে নির্বাচন পর্যন্ত সময়ে আমরা জানব না কখন, কোথায়, কীভাবে আমাদের ওপর অগ্নিগোলক এসে পড়বে কিংবা তার চরিত্রই বা কী হবে।
তাই আইনজীবী ও রাজনৈতিককর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে কতগুলো পয়েন্টের পুনরাবৃত্তি করা যাক। আমাদের ওপর অগ্নিগোলক পড়লেও কিংবা চোখের সামনে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে দেখলেও এগুলো থেকে আমাদের দৃষ্টি একেবারেই সরিয়ে নিতে দেওয়া চলবে না।
১. প্রধানমন্ত্রী মোদি ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়ে ৮০ শতাংশ চালু মুদ্রা নোটবন্দি বা ডিমনিটাইজেশনের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় তার মন্ত্রিপরিষদও আশ্চর্যান্বিত হয় বলে মনে হয়। তার পর ১ বছর ১০ মাস পেরিয়ে গেছে। এখন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, সেই মুদ্রার ৯৯ শতাংশেরও বেশি ব্যাংকিংব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। গত সপ্তাহে দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোদির এই নীতির কারণে ইন্ডিয়ার জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ উবে গেছে এবং প্রায় ১৫ লাখ চাকরি নষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে শুধু নতুন মুদ্রা ছাপাতেই দেশটিকে ব্যয় করতে হয়েছে কয়েক হাজার কোটি রুপি (১ কোটি রুপি ১.৪০ লাখ ডলারের সমতুল্য)। নোটবন্দির পর এলো পণ্য ও সেবাকর বা গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স নোটবন্দির প্রভাবে ধুঁকতে থাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর আরেক দফা আঘাত।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও গরিবরা একদিকে প্রচÐ ক্ষতিগ্রস্ত হলো, অন্যদিকে বিজেপিঘনিষ্ঠ কতগুলো করপোরেশন একই সময়ে তাদের সম্পদ বহুগুণ বাড়িয়ে নিল। কিংফিশার এয়ারলাইন্স ও বিয়ার ম্যাগনেট বিজয় মাল্য ও হীরক বণিক নীরব মোদির মতো ব্যবসায়ীকে হাজার কোটি রুপি জনগণের অর্থ হাতিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে দেওয়া হলো, অথচ সরকার যেন দেখলও না। এজন্য কতটুকু জবাবদিহিতা আমরা আশা করতে পারি? একটুও না? শূন্য?
এসবের মধ্যেই আগামী বছরের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বিজেপি বাকি সব রাজনৈতিক দলকে বিরাট ব্যবধানে পেছনে ফেলে ইন্ডিয়ার সবচেয়ে সম্পদশালী দল হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে। ভয়ানক ব্যাপার হলো, স¤প্রতি বাজারে ছাড়া নির্বাচনী বন্ড এক প্রকার অঙ্গীকারপত্র বা প্রমিজরি নোট যা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিনে তার পছন্দসই রাজনৈতিক দলকে বেনামে দান করতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পদের উৎস জনদৃষ্টির আড়ালে থেকে যাওয়া নিশ্চিত করছে।
২. সবার মনে আছে ২০১৬ সালে মোদি কর্তৃক মুম্বাইয়ে ‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’ নামক এক প্রহসন উদ্বোধনের কথা। সেখানে সাংস্কৃতিক উৎসবের মূল মঞ্চটি পুড়ে গিয়েছিল এক বিরাট আগুনে। তবে ‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’র আসল অগ্ন্যুৎসবটি হয়ে দাঁড়ায় ফরাসি সরকারের সঙ্গে রাফাল যুদ্ধবিমান চুক্তি, যার ঘোষণাটি আসে প্যারিসে ২০১৫ সালের এপ্রিলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে, অথচ তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্পষ্টতই এই ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। এটা বিদ্যমান সব প্রটোকলের বিরুদ্ধে যায়।
যে বুনিয়াদি তথ্য আমরা জানি তা হলো, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ২০১২ সালেই যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেছিল আর সেগুলো অ্যাসেম্বল করার কথা ছিল সরকারি খাতের কোম্পানি হিন্দুস্তান অ্যারোনোটিক্স লিমিটেড কর্তৃক। সেই চুক্তি বাতিল করেন মোদি এবং নতুনভাবে সাজান। হিন্দুস্তান অ্যারোনোটিক্সকে নিপুণভাবে ছেঁটে ফেলা হয়। কংগ্রেস পার্টি ও অন্যান্য যারা নতুন চুক্তিটি গভীরভাবে পাঠ করেছে তারা অকল্পনীয় মাত্রার দুর্নীতি ঘটার অভিযোগ তুলেছে। সরকার-বেসরকারি খাতের রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড কোম্পানির পক্ষে একটি ‘অফসেট’ চুক্তির জন্য দেনদরবার করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অথচ এই কোম্পানিটি ঋণে জর্জরিত এবং কখনই এটি কোনো বিমান তৈরি করেনি।
এ ব্যাপারে যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্ত দাবি করেছে বিরোধী দল। সেটা করা হবে, এমন আশা আমরা করতে পারি? নাকি পুরো যুদ্ধবিমানের বহর আর সেই সঙ্গে অন্য সবকিছু আমাদের গলাধঃকরণ করতেই হবে, একদম ঢোক না গিলে?
৩. কর্নাটক রাজ্য পুলিশ কর্তৃক সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাÐের তদন্ত চলাকালে বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে, যা আবার বেশ কয়েকটি ডানপন্থি হিন্দুত্ব সংগঠনের, যেমন চরমপন্থি সনাতন সংস্থা গোষ্ঠীর, তৎপরতা উন্মোচিত করে দিয়েছে। বেরিয়ে এসেছে ভুতুড়ে, বিকশিত এক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব, যাদের আছে হিটলিস্ট, গোপন আস্তানা ও নিরাপদ আশ্রয়, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ আর বোমাবাজি, হত্যা ও এক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্য জনগোষ্ঠীকে বিষিয়ে তোলার পরিকল্পনা।
এই ধরনের কতগুলো গোষ্ঠীর কথা সুবিদিত? এদের মধ্যে কতগুলো গোপনে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে? ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের, এমনকি হয়তো পুলিশেরও আশীর্বাদ পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়ে তারা কী ধরনের পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছে? কী ধরনের ‘ফলস ফ্যাগ’ হামলার? আর কী ধরনের সত্যিকারের হামলার? কোথায় এই হামলার ঘটনাগুলো ঘটবে? কাশ্মীরে? অযোধ্যায়? (বিজেপি যেখানে মসজিদ ভেঙে সে জায়গায় মন্দির গড়ার ওয়াদা করেছেÑ বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মদদে যেখানে ১৯৯২ সালে একদল মানুষ গুঁড়িয়ে দিয়েছে বাবরি মসজিদ।) আসামে? (যেখানে ৪০ লাখ মানুষকে বাদ রেখেই জাতীয় নাগরিক তালিকা বা এনআরসি প্রকাশ করা হয়েছে।)
কুম্ভ মেলায়? (যে হিন্দু উৎসবে আগামী বছর প্রায় ১ কোটি পুণ্যার্থী সমবেত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।) কত সহজে তারা সবকিছু বেপথো করে দিতে সক্ষম সবকিছুকেই কোনো বড় মাপের, এমনকি ছোটখাটো হামলার মাধ্যমেও পথহারা করে দিতে পারে। সেসব ঘটনা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানোর জন্য তো আছেই সরকারের গৃহপালিত গণমাধ্যমগুলো। এই দিকটি থেকে, এই সত্যিকারের হুমকি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য সা¤প্রতিক ওইসব গ্রেপ্তার নিয়ে এত শোরগোল তোলা হচ্ছে।
৪. অদম্য গতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনষ্টিকরণ। অনবদ্য রেকর্ডের অধিকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংসকরণ, শুধু কাগজপত্রে অস্তিত্বমান ভুতুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চাসন প্রদান। এটাই হয়তো সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ব্যাপার। কয়েকভাবে এটা ঘটে চলেছে। আমাদের চোখের সামনেই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা সেখানে অবিরাম হামলার মুখে। মিথ্যা ও ভুয়া বা ফেইক ভিডিও প্রচার করে শিক্ষার্থীদের জীবন বিপন্ন করার কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল। এদের নির্মম কুৎসার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু তরুণ কর্মী উমর খালিদ। এদের প্রচারণার ফলে স¤প্রতি তাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে।
এখন আমরা দেখছি ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যক্রমের ‘আহাম্মকীকরণ’ চলছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে আমরা স্থূলবুদ্ধির জয়জয়কার দেখতে পাব। সেই ক্ষতি অপূরণীয়। তদুপরি কোটা সংরক্ষণনীতি যে সামান্য সুফল বয়ে এনেছিল তাও বিনষ্ট করছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রত্যাবর্তন প্রত্যক্ষ করছি। এবার তা ঘটছে করপোরেটের লেবাসে। দলিত, আদিবাসী ও ‘অন্যান্য পশ্চাৎপদ বর্ণ’ [সরকারি নাম] প্রভৃতি জনগোষ্ঠী থেকে আগত শিক্ষার্থীদের আবারও ঠেলে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে, কারণ বেতনাদি পরিশোধের সামর্থ্য তাদের নেই। এই ঘটনা এখনই ঘটতে শুরু করেছে। এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
৫. আরও কতগুলো বিষয় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া চলবে না : কৃষি খাতে নিদারুণ দুর্দশা, কৃষক আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়া, গণপিটুনিতে বা জনতার রায়ে ফাঁসি দিয়ে মুসলমানদের হত্যা, দলিতদের ওপর নির্দয় হামলা, প্রকাশ্যে ঠেঙানো, বহুজন অধিকারবিষয়ক সংগঠন ভিমসেনার নেতা চন্দ্রশেখর আজাদের গ্রেপ্তারি [যে উচ্চবর্ণের হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছিল], ১৯৮৯ সালের তফসিলি বর্ণ ও তফসিলি ট্রাইব (নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ) আইনে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য যে আইনগত সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল তা লঘুকরণ।
এত সব বলার পর, এবার সা¤প্রতিক গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলোর ওপর দৃষ্টি ফেরানো যাক। গ্রেপ্তারকৃত পাঁচজনের কেউই উপস্থিত ছিলেন না ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুনেতে অনুষ্ঠিত এলগার পরিষদের সমাবেশে [দুজন বিশিষ্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি সাওয়ান্ত ও বিচারপতি কোসলে-পাতিল কর্তৃক আয়োজিত] কিংবা পরের দিনের প্রায় ৩ লাখ লোকের সমাবেশে, যেখানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিতরা ভিমা-কোরেগাঁও বিজয়ের ২০০তম বার্ষিকী উদযাপনের জন্য সমবেত হয়েছিল। (নিপীড়ক পেশওয়া শাসনকে পরাভ‚ত করতে দলিতরা ব্রিটিশের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলÑ যে অল্প কয়েকটি বিজয় দলিতরা সগর্বে উদযাপন করতে পারে এটা সেসবের অন্যতম)।
দ্বিতীয় সমাবেশে হামলা চালায় হিন্দুত্ববাদী ধর্মান্ধরা। তার পর কয়েকদিন ধরে অশান্তি চলে। সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য মূল অভিযুক্ত দুজন মিলিন্দ একবোটে ও সাম্বাজি ভিড়ে। দুজনেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। বরং তাদেরই এক সমর্থকের দায়ের করা এফআইআরের পরিপ্রেক্ষিতে গত জুন মাসে পুনে পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেনÑ দিল্লির রাজনৈতিককর্মী রোনা উইলসন, মুম্বাইয়ের দলিত অধিকারকর্মী সুধীর ধাওয়ালে, নাগপুরের অধ্যাপক সোমা সেন, প্রধানমন্ত্রীর গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচির সাবেক ফেলো মাহেশ রাউত এবং আইনজীবী সুরেন্দ্র গাডলিং।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, পহেলা জানুয়ারির সমাবেশে সহিংসতার চক্রান্ত এবং প্রধানমন্ত্রী মোদিকে হত্যার পরিকল্পনা করা। তারা এখনো আটক আছেন, অত্যন্ত কঠোর বেআইনি কর্মকাÐ (প্রতিরোধ) আইনের আওতায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। তাদের ভাগ্য ভালো যে, তারা এখনো জীবিত। একই অপরাধে অভিযুক্ত উনিশ বছরের ইশরাত জাহান কিংবা সোহরাবুদ্দিন শেখ ও তার স্ত্রী কাউসার বাইয়ের মতো পুলিশের ভাষায় ‘এনকাউন্টারে’ তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়নি।
মহারাষ্ট্র রাজ্য পুলিশ বলছে, সা¤প্রতিক গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলো জুন মাসে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া দলিল থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে করা, যা অভিযুক্ত সবাইকে এলগার পরিষদ ও ভিমা-কোরেগাঁও সমাবেশে সহিংসতা ঘটানোর জন্য অর্থ জোগান ও উসকানি প্রদানের চক্রান্তে জড়ানো ছাড়াও নরেন্দ্র মোদিকে হত্যার চক্রান্তেও জড়িয়ে ফেলে। বিচারপতি সাওয়ান্ত ও বিচারপতি কোলসে-পাতিল প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, তারাই ছিলেন মূল আয়োজক এবং এলগার পরিষদের একক অর্থ জোগানদাতা আর তাদের উদ্দেশ্য বিভক্তিকামী হিন্দুত্বের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে জনতার সমাবেশ ঘটানো। সেদিনের ঘটনাবলির পুরো দায় তারা দুজনে নিয়েছেন। তথাপি পুলিশ ও সরকার তাদের সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করছে। এর পেছনে অবশ্য তাদের কারণও আছে।
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ ও পূর্ববর্তী বিজেপি উভয় সরকারের জন্য আদিবাসীদের ওপর হামলাকে ‘মাওবাদী’ কিংবা ‘নকশালপন্থি’দের ওপর হামলার ছদ্মাবরণ দেওয়া জরুরি ছিল। আর এখন বিজেপি দলিতদের ওপর তাদের হামলাকে একই ছদ্মাবরণ দিচ্ছে। এটির কারণ, প্রতিটি মুখ্য রাজনৈতিক দল আদিবাসী ও দলিত অধ্যুষিত নির্বাচনী এলাকাগুলোকে তাদের সম্ভাব্য ভোটব্যাংক হিসেবে দেখতে চায়।
মুসলমানদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা ভিন্ন, কারণ নির্বাচনী পাটীগণিতে তারা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ও অধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার এবং তাদের মাওবাদী বা নকশালপন্থি জঙ্গি বলে অভিহিত করার মাধ্যমে সরকার দলিত আকাক্সক্ষাকে দলন ও অপমান করে। এ কাজটি করা হয় একদিকে ভিন্ন নামে চিহ্নিত করে আর অন্যদিকে ‘দলিত ইস্যুর’ প্রতি সহানুভ‚তিশীল থাকার ভান জারি রেখে। আজ সারাদেশে হাজার হাজার মানুষ জেলখানায়। তারা গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত, লড়াই করে চলেছে নিজের ঘরের জন্য, ভ‚মির জন্য, তাদের মর্যাদার জন্য। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কিংবা আরও গুরুতর কোনো অভিযোগ, জনাকীর্ণ জেলখানায় পচে মরছে বিচারহীন অবস্থায়।
তিন আইনজীবী ও সাতজন সুপরিচিত রাজনৈতিক ও অধিকারকর্মীর গ্রেপ্তারের ঘটনা সব ধরনের নাজুকতার মধ্যে থাকা মানুষের ন্যায়বিচার অথবা প্রতিনিধিত্বের যে কোনো আশা ধূলিসাৎ করে দিতেও ভ‚মিকা রাখবে। কেননা এরাই ছিল তাদের প্রতিনিধি। কয়েক বছর আগে আধাসামরিক বাহিনী ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা আদিবাসী মিলিশিয়া বাহিনী সালওয়া জুদুম খনিসমৃদ্ধ বাস্তার বনাঞ্চলে তাণ্ডবলীলা চালায় মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণ, পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটায়। হামলার শিকার মানুষের পক্ষে তখন সোচ্চার হন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিভার্টিজের ছত্তিশগড় রাজ্যের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ডা. বিনায়ক সেন।
বিনায়ক সেনকে জেলে পাঠানো হলে তার জায়গায় চলে আসেন সুধা ভরদ্বাজ, যিনি আইনজীবী ও শ্রমিক সংঘ নেতা হিসেবে এলাকাটিতে কাজ করেছেন বহু বছর। বিনায়ক সেনের পক্ষে দাঁড়ান অধ্যাপক সাইবাবা, যিনি বাস্তারে আধাসামরিক বাহিনীর অভিযানের বিরুদ্ধে নিরলসভাবে প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। সাইবাবা যখন গ্রেপ্তার হলেন, তার পক্ষে দাঁড়ালেন রোনা উইলসন। সুরেন্দ্র গাডলিং ছিলেন সাইবাবার আইনজীবী। তারা যখন রোনা উইলসন ও সুরেন্দ্র গাডলিংকে গ্রেপ্তার করল, তাদের জন্য দাঁড়ালেন সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নবলাখা ও অন্যরা আর এভাবেই চলতে থাকে।
নাজুক মানুষরা আজ ঘেরাও হয়ে আছে, তাদের মুখে তালা। উচ্চকণ্ঠ আজ অবরুদ্ধ। ঈশ্বর সহায় হোন আমরা যেন আমাদের দেশটা ফিরে পাই!
নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস থেকে
অনুবাদ : মুহাম্মদ হাবীব