তরুণরা নিশ্চয় ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না
দৈনিক সিলেট ডট কম
ড. আতিউর রহমান: আসন্ন নির্বাচনে তরুণ ও নারী ভোটাররা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে সব পর্যবেক্ষকের ধারণা। আমরা জানি, মোট ভোটারের অর্ধেক নারী। কিন্তু এবার ১৮-২৪ বছর বয়সী ২ কোটি ৩১ লাখ নয়া ভোটার যুক্ত হয়েছে ভোটার তালিকায়। এরা প্রথমবারের মতো ভোট দেবে। ধারণা করা যায়, এই তরুণরা বাংলাদেশের গৌরবান্বিত স্বাধীনতার পক্ষে। পাশাপাশি এরা প্রযুক্তিপ্রেমী। তথ্যপ্রবাহে সর্বক্ষণ অবগাহন করা এই তরুণদের মনের খবর আমরা পুরোপুরি রাখিÑ সে দাবি আমি করব না। তবে সম্প্রতি সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকশ তরুণের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর আমার মনে হয়েছে,
এরা উন্নত বাংলাদেশেরই স্বপ্ন দেখে। মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা এদের আকর্ষণ করে। সুশাসনের ঘাটতি তাদের বিমর্ষ করে। লাগামহীন দুর্নীতি তাদের হতাশ করে। ধর্মান্ধতা, উগ্রবাদ ও শক্তিমত্ততার তারা বিরুদ্ধে। তাই কতিপয় ‘প্রগতিশীল’ মানুষ গণতন্ত্রের নামে যখন স্বাধীনতাবিরোধীদের মার্কায় বিলীন হয়ে যান, তখন তরুণরা বিভ্রান্ত হয়, কিংবা ক্ষুব্ধ হয়। তারা ক্রিকেটপ্রেমী। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিজয়ে তারা লাফাতে থাকে। হাজার হাজার তরুণ একসঙ্গে ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে ওঠে। নিশাত ও মুহিতের হাত ধরে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শিখরে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়তে দেখে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়। পাকিস্তানের চেয়ে মাথাপিছু আয় ও সামাজিক উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশ বিরাটভাবে এগিয়ে রয়েছে জেনে তারা দারুণ খুশি। প্রায় এক দশক ধরে বাড়ন্ত অর্থনীতি, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানিপ্রবাহ লাগাতার বেড়ে চলা, দারিদ্র্য-অভাব-অনটন দ্রুত কমে আসার খবরে তারা সত্যি উজ্জীবিত। কথা বলতে এরা খুবই আগ্রহী। তবে সাম্প্রদায়িক উসকানিতে তারা উদ্বিগ্ন হয়। গণতন্ত্র তাদের কাছে নিত্যদিনের বিষয়। এক দিনের ভোট দেওয়াকে গণতন্ত্র মনে করে না। সামাজিক দায়িত্ববোধ তাদের তাড়া করে। পথশিশুদের এক টাকায় খাবারের ব্যবস্থা করা, তাদের জন্য অনানুষ্ঠানিক স্কুল পরিচালনা করার মতো মানবিক গুণের স্বাক্ষর তারা রেখে চলেছে। প্রশ্ন করা যেতে পারেÑ এই তরুণরা এবার কি ভোটকেন্দ্রে যাবে? গেলে তারা কোন পথে হাঁটবে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে অনুমান নিশ্চয়ই করা যায়। সম্প্রতি ‘কলরেডি’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান এক হাজার আশি তরুণের ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে জানিয়েছেÑ তাদের ৫১.৩ শতাংশই স্থিতবস্থায় বিশ্বাসী। অর্থাৎ তারা বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পক্ষে ভোট দেবে। আমি অবাক হইনি। তবে প্রণিধানের বিষয় হলো উত্তারদাতাদের ১৮.৫ শতাংশ জরিপের সময় তাদের সিদ্ধান্তহীনতার কথা জানিয়েছে। এরাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বর্পূ ‘সুয়িং ভোটার’। প্রত্যেক প্রার্থীকেই এদের কথা মাথায় রাখতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন ও প্রচারের সময় এদের কথা মাথায় রাখতে হবে। আরও মাথায় রাখতে হবে, ওই জরিপের উত্তরদাতাদের ১৬.৭৫ শতাংশ ছিল সুশাসনের পক্ষে, ১৫.৭০ শতাংশ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং ১১.৫৪ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পক্ষে।
এই প্রেক্ষাপট মনে রেখে একজন সমাজগবেষক হিসেবে নিচের আঁচ-অনুমানগুলো পাঠকদের জানাতে চাইছি। অবশ্য বাস্তবে তা কতটা সত্যি হবে, সে জন্য নির্বচানের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এক. আমার বিশ্বাস তরুণরা এক দশক ধরে বাড়ন্ত অর্থনীতির পক্ষেই থাকবে। বিগত বছরগুলোয় তারা দেখেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটলে উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ে; আর সে জন্য বাড়ে স্বনিয়োজন ও মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান। আগামী দিনগুলোয় অর্থনীতি আরও বেশি হারে বাড়বে। তাই তাদের নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি’ বা স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক মন্দা বা দুরবস্থার পরিস্থিতি তো সামনে নেই। তাই কেন তরুণরা একটা বাড়ন্ত অর্থনীতির চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে পা ভাঙবে।
দুই. একশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, একাধিক সফটওয়্যার পার্কসহ প্রস্তাবিত মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে প্রবৃদ্ধি দশ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অসংখ্য নয়া উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। আর বিপুল পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। এমন আশাজাগানিয়া উন্নয়ন অভিযাত্রা থেকে কেন তরুণরা স্বেচ্ছায় ছিটকে পড়তে চাইবে?
তিন. ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে অর্থনীতির ‘উদারীকরণ’ ঘটেছে। লাখ লাখ মানুষ ‘উবার’, ‘পাঠাও’, ‘সহজ’, ‘ওভাই’, ‘ওবোন’ অ্যাপস ব্যবহার করে এখন সহজেই পরিবহন সেবা নিচ্ছে। লাখ লাখ তরুণ এসব কর্মসূচির অংশীদার (চালক) হিসেবে নিজেদের আয়রোজগার নিশ্চিত করছে। ছাত্রছাত্রীরাও এই কাজ করছে। প্রতি ইউনিয়নে ডিজিটাল কেন্দ্র, মোবাইল ব্যাংক ও এজেন্ট ব্যাংকের কল্যাণে দশ লাখেরও বেশি তরুণ উদ্যোক্তা এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। আরও কয়েক লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তারা করেছে। আর তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের দ্রুত সেবার কথা না-ইবা বললাম। এই ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে তরুণরা কী কারণে মুখ ফিরিয়ে নেবে?
চার. বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন নীতি এবং প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর সাম্য সূচকে বাংলাদেশ এখন এক নম্বরে। বিশ্বে তার অবস্থান ৪৭তম। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার নারী উদ্যোক্তাকে নানাভাবে নীতি সমর্থন ও অর্থায়ন দিচ্ছে। এমন নারী-সংবেদনশীল স্থিতাবস্থা পায়ে দলে কেন নারীসহ আমাদের আশাবাদী তরুণরা ভিন্ন পথে হাঁটবে?
পাঁচ. অনস্বীকার্য ‘হলি আর্টিজান’ দুর্যোগের পর প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সচেষ্ট সমাজ ধর্মান্ধতা ও উগ্রতারও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দারুণ পারদর্শিতা দেখিয়েছে। তাই সমাজে এখন শান্তি বিরাজ করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও পর্যটকরা বাংলাদেশে ফের বিপুলসংখ্যায় আসছে। তারা দেশের আনাচে-কানাচে নির্ভয়ে ঘুরছে ফিরছে। তরুণরা কেন এই সামাজিক শান্তির পরিবেশ নিশ্চিতকারী নেতৃত্বকে শুধু শুধু পরিহার করবে?
ছয়. বছরের প্রথম দিনেই সব স্কুল ছাত্রছাত্রীকে সরকার বই দিচ্ছে। শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বাড়ছে। আগামীতে গুণমানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের আরও সুযোগ বাড়াতে বদ্ধপরিকর বর্তমান সরকার। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তরুণদের কথা কিন্তু সরকার শুনেছে। তাদের দেখানো সংস্কারে সরকার হাত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপূর্ণতা থাকতে পারে। তবে সদিচ্ছার অভাব ছিল না। এ কথাও সত্যি যে, এই সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি বিসিএস অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তরুণরা চাকরির সুযোগ পেয়েছে। শিক্ষা ছাড়াও স্বাস্থ্য, পুষ্টি উন্নয়নেও সরকার নীতি সমর্থন ও অর্থায়ন বাড়িয়ে মানব উন্নয়ন সূচকে দারুণ উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এমন আশাবাদী মানব উন্নয়নের ধারা সত্ত্বেও তরুণরা কেন স্থিতাবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে?
সাত. জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, এসডিজি অর্জন, বদ্বীপ পরিকল্পনাসহ অসংখ্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে বর্তমান সরকার। সারাবিশ্ব বাংলাদেশের এই পরিকল্পিত উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করছে। তরুণরা কেন এই প্রশংসার ভাগিদার হতে চাইবে না?
আট. দশ লাখ রোহিঙ্গার জীবনচলা নিশ্চিত করা বর্তমান সরকার ‘মাইগ্রেশন’ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্বে এক নয়া নজির স্থাপন করেছে। আমাদের তরুণরা কেন বিশ্ববাসীর এই প্রশংসার অংশীদার হতে দ্বিধা করবে?
সব শেষে বলতে পারি, ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। এ মাসেই লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। এই বিজয়কে ‘শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির’ পথে পরিচালিত করতে করতেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে তিনি শহীদ হন। তা সত্ত্বেও সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জনের পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ তারই সুযোগ্য কন্যার হাত ধরে। আজকের তরুণরা নিশ্চয় শান্তি ও সমৃদ্ধির এই বাংলাদেশ অর্জনের পথে না হেঁটে ‘অদ্ভুত এক উটের পিঠে অন্ধকারের’ পানে হাঁটবে না। কাকে তারা এই দেশের কা-ারি করবে, নিশ্চয়ই তারা সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। অভিজ্ঞ, সংগ্রামী ও পোড়খাওয়া এক নেত্রীকে, নাকি সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির প্রতীক কোনো অর্বাচীন অপরাজনীতিককে? আমার বিশ্বাস আসন্ন নির্বাচনে তরুণরা নিশ্চয় ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না।
ড. আতিউর রহমান : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ