রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে হাজারো সমস্যা

দৈনিক সিলেট ডট কম
আহমদ রফিক: রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা বাংলাদেশে নতুন এক অশুভ মাত্রা অর্জন করে চলেছে, যা একান্তভাবেই রাজনৈতিক-সামাজিক ও নানামাত্রিক অনৈতিকতার সমস্যা। এককথায় শুদ্ধ মানবিক মূল্যবোধের পরাজয়। শুরুতে কিছুটা হলেও এমন কিছু আশঙ্কার কথা কারও কারও বক্তব্যে উঠে এসেছিল, যা সমালোচিত হয়েছিল মানবতাবাদী বিবেচনায়। তখন বিপন্নকে আশ্রয়দানই বড় কর্তব্য হয়ে ওঠে। সে অনুযায়ী শরণার্থীদের আশ্রয়দান চট্টগ্রামের সমুদ্র সীমান্ত এলাকায়, বিশেষ করে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া প্রভৃতি জনপদে।
এগিয়ে আসে জাতিসংঘের ত্রাণ-শরণার্থী শাখা সহায়ক ভূমিকা নিয়ে অর্থ ও কর্মতৎপরতায়। তৈরি হতে থাকে বিশালকায় শরণার্থী শিবির। স্বদেশভূমি থেকে বিতাড়িত ও প্রাণভয়ে আতঙ্কিত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায় তরুণ ও যুবক রোহিঙ্গাদের একাংশে ভিন্ন ধরনের মতিগতি। তারা দুষ্টু বলয়ে নানা অনৈতিকতায় ব্যবহূত হতে থাকে।
এর মধ্যে এনজিওগুলোর অনুপ্রবেশ তাদের নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে সহায়ক ভূমিকা পালনে। এনজিওর শক্তিমান অংশ যে সাম্রাজ্যবাদী আন্তর্জাতিক স্বার্থের তাঁবেদার- এ অভিযোগ বহুজনের এবং তা দীর্ঘদিনের। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটচালের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের প্রধান মাধ্যম বৈশ্বিক মানের বড়সড় এনজিও।
বাংলাদেশ যখন মানবিক চেতনার টানে রোহিঙ্গাদের সাময়িক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেয়, তখন বুঝতে পারেনি এর সঙ্গে কতটা বহুমাত্রিক সমস্যা তৈরি হতে পারে, যা দেশের সমাজ ও ন্যায়নীতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থবিরোধী। অন্যদিকে এর পেছনে কতটা নিহিত থাকতে পারে নানা ধরনের অনৈতিক ও অবৈধ স্বার্থপরতার খেলা, এমনকি অপরাধপ্রবণতার সামাজিক সমস্যা।
এখন ক্রমে তা পরিস্ম্ফুট হচ্ছে। তাতে জড়িয়ে পড়ছে স্থানীয় অপরাধ চক্র, অপরাজনীতির অবাঞ্ছিত নানা দিক। এমন আশঙ্কার কথা রোহিঙ্গাদেরও জানা ছিল না যে, তাদের শরণার্থী জীবনে নানা অবাঞ্ছিত অপশক্তির অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। সমাজের দুর্বৃত্ত চক্র সর্বদাই অসহায় জনগোষ্ঠীর দিকে নজর রাখে সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য, হোক তা স্বজাতি-বিজাতি।
দুই
সম্ভবত তেমন কোনো ধারণা ছিল না বাংলাদেশি প্রশাসনেরও। মনে হয় থাকা উচিত ছিল প্রশাসনিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার দায়ে। এটা আন্তর্জাতিক তথা বৈশ্বিক বাস্তবতা এবং দেশ ও কাল-নির্বিশেষ। এখন ঘটনা ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে অনেক অপ্রিয় সমস্যার সম্মুখীন করে দিচ্ছে। এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার। সে ব্যবস্থা হতে হবে কঠিন ও ন্যায়নীতির।
দুর্ভাগ্যজনক যে, সংশ্নিষ্ট সমস্যাগুলোকে বিভিন্ন সূত্রে এখনও সঠিক গুরুত্বে গ্রহণ করা হচ্ছে বলে মনে হয় না- যেমন সংবাদপত্রে, তেমনি প্রশাসনে, তেমনই সচেতন সুধী সমাজে। তবে দু-একটি দৈনিকে যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ও সংশ্নিষ্ট বিষয়ক সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে, তা সমাজ ও প্রশাসনের সচেতন হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
প্রমাণ মিলছে প্রশাসনের সর্বোচ্চ শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া ও বিবৃতিতে। রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে সংঘটিত কিছু আপত্তিকর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশাসনিক মন্তব্য :’এখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলতে পারে না।’ শুধু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, অনুসন্ধানী সাংবাদিকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এখানে চলছে রীতিমতো অবৈধ, ন্যায়নীতিবিরোধী, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, যা সামাজিক দুর্বৃত্তায়নের তুল্যমূল্য। নারী নির্যাতন
থেকে নারী পাচারের চরম অপরাধমূলক ব্যবসা, মাদক ও অনুরূপ বাণিজ্যের অংশীদার হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো। জড়িত যেমন রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি দুর্বৃত্তচক্র।
এ সম্বন্ধে কয়েকটি দৈনিকপত্রে যে ধরনের খবর প্রকাশিত হয়েছে বা সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, সেসবের মর্মার্থ রীতিমতো উদ্বেগজনক। একদিকে নানামাত্রিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অন্যদিকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং রাজনৈতিক অপশক্তির নানা উপায়ে উস্কানির অভিযোগ- যাতে শরণার্থীরা তাদের স্বদেশে ফিরে না যায়। আরও চমকপ্রদ ঘটনা জাতিসংঘের নানা মাধ্যমে প্রকাশিত যে, রাখাইনে বিরাজমান পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার অনুকূলে নয়। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে নয়।
তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়াল? অর্থাৎ মিয়ানমারের মন্ত্রীর শরণার্থী শিবির পরিদর্শন, বিবৃতি এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সম্পাদিত চুক্তি সবই অর্থহীন, চতুর রাজনৈতিক খেলা বৈ কিছু নয়। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের ঘটনাও প্রকৃতপক্ষে অনুরূপ। বাংলাদেশের কথিত মিত্র দেশগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নীরব বলা চলে। এমনকি প্রতিবেশী একান্ত মিত্র ভারতের ভূমিকাও অনুকূল নয়। ভিন্ন নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা নিজ নিজ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের পথ ধরে চলছে। বাংলাদেশের স্বার্থ তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়।
এমন এক পরিস্থিতিতে শরণার্থী রোহিঙ্গারা, বিশেষত এদের তরুণ-যুবাগোষ্ঠী বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসে ইচ্ছুক- দু’একটি সংবাদ প্রতিবেদনে তেমনটিই প্রকাশ পেয়েছে। জেনেশুনে কে তরবারির নিচে গলা পেতে দেয়? একাধিক রোহিঙ্গা যুবার এমন অভিমত প্রকাশ পেয়েছে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে। দেশের মাটি, বাস্তুভিটার প্রতি ঐতিহ্যবাহী আকর্ষণ এদের মধ্যে অনুপস্থিত মূলত নিরাপত্তার বিবেচনায়।
এদের এই জাতীয় মনোভাবের পেছনে কাজ করছে একাধিক কারণ, যেমন- পূর্বোক্ত মিয়ানমার জান্তারও দুষ্টশক্তির সুচতুর কৌশলী হুমকি ও উস্কানি, অন্যদিকে স্থানীয় এনজিওগুলোর কথিত অনুরূপ ভূমিকা। এদের সহায়তার নামে বিপুল পরিমাণ বৈশ্বিক অনুদান আদায় এবং সেখান থেকে অনুরূপ মাত্রায় অর্থ স্বার্থ আদায়ের মতো ঘটনাদি নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। এক কথায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা পক্ষে, নানা স্বার্থের খেলা চলছে। মধ্যখানে ভুগছে বাংলাদেশ।
একটি সংবাদপত্রের শিরোনাম :’এদেশ ঘিরেই স্বপ্ন বুনছে রোহিঙ্গারা’- এটি বাস্তব ভাবনার প্রকাশ বলেই আমার মনে হয়। বিশেষ করে মিয়ানমার ও তাদের মিত্র আন্তর্জাতিক শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্নেষণ করে দেখলে। এমনই প্রকাশ পেয়েছিল বছর দেড়েক আগে যখন কয়েক লাখ বাস্তুচ্যুত, বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সাগর-সীমান্তে আশ্রয় নেয়।
এ প্রসঙ্গে কারও কারও অভিযোগ, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যতটা কঠোর-কঠিন কূটনৈতিক তৎপরতা প্রকাশের প্রয়োজন, ততটা করতে পারছে না। পারছে না নিরাপত্তা পরিষদের রাষ্ট্রশক্তিগুলোকে প্রভাবিত করতে। বিস্ময়কর যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ বলে পরিচিত ভারতকেও এ তৎপরতায় মাঠে নামাতে পারছে না বাংলাদেশ। কেন পারছে না ভারতকে এত সুবিধাদানের পরিপ্রেক্ষিতে?
তিন
এসব ঘটনার পরিণাম বাংলাদেশের জন্য যে রাজনৈতিক বিবেচনায় শুভ হতে পারে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে দেখা যাক এর বিপরীত বিরাজমান দিকটা অর্থাৎ শরণার্থী শিবিরে কেমন আছেন রোহিঙ্গারা- নারী, বৃদ্ধা, তরুণী, শিশু? এনজিওগুলোর সুচতুর তৎপরতার মধ্যে? ক্যাম্পজীবন যে আদৌ সুখকর নয়, তার প্রমাণ তো বিহারি-আবাসস্থল জেনেভা ক্যাম্প। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, ভিন্ন আলোচনার, বারান্তরের জন্য।
আপাতত রোহিঙ্গা শিবির বিবেচনায় দেখা যায়, এখানে চলছে নানা ধরনের অশুভ অপতৎপরতা, অপরাধপ্রবণতা এবং সংশ্নিষ্ট আরও কিছু। ইতিপূর্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি শিরোনামই পরিস্থিতি বোঝার পক্ষে যথেষ্ট : ‘সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্ক রোহিঙ্গা শিবিরে’/’গুম-খুনের শিকার হচ্ছেন সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ-বিরোধীরা’ (১০.৩.২০১৯)।
ঘটনা বিচারে আমাদের প্রথম প্রশ্ন- শরণার্থী শিবিরের যথাযথ নিরাপত্তা বিধানে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা? কী করছেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা সদস্যরা? শিবিরের অভ্যন্তরে চলছে যত রকমের অনাচার, বিশেষ করে নারী ও তরুণীদের নিয়ে। বহু প্রচলিত শব্দ ‘পাচার’, ‘তুলে নিয়ে যাওয়া’ ইত্যাদিও বাদ যাচ্ছে না। এসবে সংশ্নিষ্ট উভয় পক্ষীয় সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্ত দল- রোহিঙ্গা ও স্থানীয়, যা ইতিপূর্বে উল্লিখিত।
এ ছাড়াও পূর্ব সূত্রে জন্ম নিচ্ছে তরুণ-যুবকদের মধ্যে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ, এমনকি ধর্মীয় জঙ্গিবাদ- কয়েকজন হিন্দু রোহিঙ্গাকে জোর করে ধর্মান্তরিত করার মতো ঘটনাও প্রমাণ করে, কী রকম নৈরাজ্য বিরাজ করছে কোনো কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে! পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে কিছুটা বিশদ বিবরণ রয়েছে অনাচারের। অন্যদিকে ঘটনা যে একতরফা নয়, তারও নমুনা এমন শিরোনামে :’রোহিঙ্গায় পিষ্ট স্থানীয় নারী’। পরিবর্তন ঘটছে সাংস্কৃতিক আচার-আচরণে।
সংক্ষিপ্ত বয়ানে এটুকু বলা যায়, রোহিঙ্গা বসতি বিচিত্র সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে বাংলাদেশের মাটিতে, মূলত চট্টগ্রাম সীমান্তে। যত দিন যাবে সমস্যার মাত্রা-চরিত্র নানারূপে বাড়তে থাকবে। তাই এসব দুষ্ট সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে একমাত্র পথ অতি দ্রুত রোহিঙ্গা শরণার্থীর তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া। বলা বাহুল্য, সে ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে কঠিন অবস্থান নিতে হবে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি উভয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থে।
ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি
সমকাল