‘বড় আদরের ছোট বোন’

দৈনিক সিলেট ডট কম
আলম ফরাজী: ২০১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি। নড়াইলের কালিয়ার কলাবাড়িয়া গ্রামে কলেজছাত্রী ফাতেমাকে পারিবারিক বিবাদে মেরেই ফেলেছেন তার বড় ভাই রিপন মোল্লা। যশোরের মণিরামপুরে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জমি নিয়ে রেষারেষির জেরে ছোট বোন নূরজাহানকে দা দিয়ে কুপিয়ে মারেন ভাই আবদুর রহিম। আর গেল বছরের ২১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের ইব্রাহিমপুরে পারিবারিক মনোমালিন্যে বড় ভাই সজলের জীবন কেড়ে নেন ছোট বোন রুমা। এমনই পারিবারিক সহিংসতা যখন চারদিকে, তখনই ময়মনসিংহের নান্দাইলের এক ছোট বোন নাড়া দিয়েছে সবাইকে। ভাইকে বাঁচাতে নিজের প্রাণটারই ইতি টানলেন ছোট্ট বোনটি। ‘সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন’-জনপ্রিয় শিল্পী মান্না দে’র কালজয়ী মর্মস্পশী গানটিই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে হয়তো বা এখন বেশি মনে পড়ছে বড় ভাই শহীদের। ছোট্ট বোনটির জন্যই তো তিনি এখনো পৃথিবীর আলো দেখছেন, বাতাসের সংস্পর্শে আছেন।
গ্রামের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, অন্যের পরিবারের ঝগড়া-বিবাধের সমাধান ছাড়াও বাল্যবিয়ে ঠেকানোর ব্যাপারে ইতি আক্তারের (১৬) ছিল দারুণ সুখ্যাতি। কেউ ডাকুক, আর না ডাকুক খবর পেলেই হলো! গ্রামবাসীর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত সাহসী এই কিশোরী। ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে প্রতিপক্ষের বল্লম ক্ষতবিক্ষত করে দেয় প্রতিবাদী ইতিকে। সারা জীবনের জন্য থেমে গেছে জীবনগাড়ি। গত শনিবার সকালে ময়মনসিংহের নান্দাইলের রাজগাতি ইউনিয়নের বনাটি বাজুপাড়া গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধে চাচাতো ভাই রিপন শহীদকে লক্ষ করে বল্লম ছুড়ে মারে। ভাই শহীদকে বাঁচাতে সেই বল্লমের সামনে গিয়ে পড়ে ইতি। সেই ছোড়া বল্লম গলায় বিদ্ধ হলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে ইতি মারা যায়। তার এই মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছে না গ্রামবাসী। সবার একটাই আকুতি—জড়িতদের বিচার চাই।
এ ঘটনায় পুলিশ হত্যাকারীর মা, বোন ও চাচাকে গ্রেপ্তার করে। পরে রাতেই মূল হোতা রিপনসহ ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করা হয়। আহত শহীদ এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বোনের এমন মৃত্যুতে তিনি নিজেকেই দায়ী ভাবছেন। কাঁদছেন অঝোরে।
গতকাল রবিবার সকালে গিয়ে দেখা গেল ইতির গ্রাম পুরোটাই স্তব্ধ। এ হত্যার বিচার চেয়ে গ্রামের মানুষ নীরবে ফুঁসছে। গ্রামের কয়েকজন বললেন, ‘এই ইতিই ছিল আমাদের বিপদের ভরসা। নিজে থেকে কিছু বলতে হয়নি। সব ক্ষেত্রেই সে এগিয়ে আসত। আমেনা বেগম নামের এক নারী জানান, তিন মাস আগে তাঁর বাড়িতে চোর ঢোকে। ওই সময় চিৎকার শুরু করলে কেউ এগিয়ে না এলেও ইতি একটি বাঁশ নিয়ে ছুটে এসে সাহস জোগায়। এরপর অন্যরা এলে চোরের দল পালিয়ে যায়। গ্রামবাসী জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিলে যৌতুকের জন্য স্বামীর বাড়িতে নির্যাতন চললে বিচার চেয়েও কোনো লাভ হয়নি। এ অবস্থায় ইতি তার বিদ্যালয়ের বান্ধবীসহ মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে আসে। পরে একটা সমাঝোতায় ফের মেয়েকে স্বামীর বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। এখন সে সুখেই আছে।’
হালেমা বেগম জানান, তাঁর মেয়ের সন্তান প্রসবের সময় হলে দুই দিন ঘরেই প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাতে থাকে। এ অবস্থায় ইতিই তাঁর দুই বান্ধবীকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেখানেই সন্তানের জন্ম হয়।
ইতির বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায়, মা ও বোনরা বুক চাপড়ে কান্না করছেন। ইতির বই-খাতা নিয়ে আগলে ধরে পরনের কাপড় দিয়ে মুছছেন। বোন রত্না জানান, তাঁর বোন ইতি ছিল সাহসী ও প্রতিবাদী। পাগলপ্রায় বাবা সাহেদ আলীর চোখে পানি না থাকলেও কথা একটাই—‘আমার কইলজারে হে (রিপন) বল্লম দিয়া মাইর্যা ফালছে। আমার কইলজারে আইন্যা দেও।’
ইতি অসুস্থ থাকার কারণে গত বছর স্থানীয় কাশিনগর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হয়েছিল। তবে দমে যায়নি। আগামীতে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতিও ছিল। তার বেশ কয়েকজন বান্ধবী ও সহপাঠী জানায়, এলাকায় কোনো বাল্যবিয়ে হতে দেয়নি ইতি। নিজে চেষ্টা করে না পারলে ৯৯৯ (হেল্পলাইন) ছাড়াও উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়ে বন্ধ করে দিত বাল্যবিয়ে।-সৌজন্যে:কালের কন্ঠ