নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
দৈনিক সিলেট ডট কম
রনি স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু মোজা খুঁজে পাচ্ছে না। মোজা ছাড়া সে স্কুলের সু একদম পরতে পারে না। সু ছাড়া আবার স্কুলের গেট পার হওয়া মশকিল। তবে কোনো রকমে গেট পার হয়ে গেলে আর কোনো সমস্যাই নেই। কিন্তু সু ছাড়া ‘গেট দাদু’ স্কুলে ঢুকতে বড় ঝামেলা করেন।
রনি ক্লাস নাইন এ সেকশন এর ফার্স্ট বয়। ফার্স্ট বয়ের জন্য কোনো অন্যায়ই গুরুতর না। টিচাররা তাদের আলাদা চোখে দেখেন। তাছাড়া রনি গত বছরের জেএসসি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে স্কলারশীপ পেয়েছে। গেট দাদু এসব খোঁজ রাখলে নিশ্চয়ই তার সাথে এরকম করতেন না। কিন্তু তার কাছে সবাই সমান।
রনি স্যান্ডেল পরেই ঘর থেকে বের হলো। সাদা শার্ট, নীল প্যান্ট পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সে রওনা দিলো।
উঠোনে ছোট চাচা খবরের কাগজ পড়ছেন। ছোট চাচাকে দেখে রনির বুক ধড়ফড় করছে। এমন সময় ছোট চাচা তাকে ডাক দিলেন। রনি ছোট চাচার সামনে গিয়ে চোখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে তিনি রনিকে জিজ্ঞেস করলেন, যাচ্ছিস কোথায়?
এ কেমন প্রশ্ন! স্কুল ড্রেস পরে সে কোথায় যাবে? রনি কোনো জবাব দিচ্ছে না। ছোট চাচা খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে রনির পায়ের দিকে তাকালেন।
‘স্কুলে যাচ্ছিস?’
‘জ্বী।’
‘আচ্ছা যা।’
রাস্তায় বের হয়েই রনি দেখে গাড়ি-ঘোড়া একেবারে কম। মানুষও তেমন নেই। তার ক’দিন জ্বর ছিল। তাই স্কুলে যেতে পারেনি। এর মধ্যে সব এমন বদলে গেল। কেমন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে রনি একটা রিক্সা পেয়েছে। রিক্সাওয়ালা মাঝ বয়সী। ফাঁকা রাস্তায় তিনি রিক্সা নিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলছেন। মাঝেমধ্যে কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মুছছেন। হঠাৎ তিনি পেছন ফিরে রনিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনে তো ভালো স্কুলে পড়েন। আচ্ছা কন দেহি আমরা স্বাধীন কিনা?
রনি একটু অবাক হলো। হুট করে এমন একটা প্রসঙ্গ রিক্সাওয়ালা কেন তুলল তার মাথায় ঢুকছে না। রনি বলল, জ্বী আঙ্কেল আমরা স্বাধীন। আমাদের দেশটাও স্বাধীন। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ আমরা স্বাধীনতা লাভ করি।
‘স্বাধীন বইলাই যা ইচ্ছা তাই করমু?’
‘কেন কি হয়েছে বলেন তো?’
‘আপনে দেখতাছি কিছুই জানেন না। গতকাইল দুইটা বাস ধাক্কা দিয়া স্কুলের দুই বাচ্চারে মাইরা ফেলল। ক’জন এখন হাসপাতালে আছে।’
‘বলেন কি!’
রনি খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। এজন্যই বোধহয় আজ রাস্তাঘাট এতটা ফাঁকা। এমন দিনে তার বাসা থেকে বের হওয়া একদম ঠিক হয়নি।
রনি স্কুলে ঢুকতেই দেখল গেটে কেউ নেই। সে দ্রুত গেট পার হয়ে গেল। স্কুলে সবাই হৈ চৈ করছে। টিচাররা অফিস রুমে। কেউ কেউ বলছে, আজ স্কুল ছুটি দিয়ে দিবে।
রনি এতদিন পর স্কুলে এসেছে। আসার পরই যদি স্কুল ছুটি হয়ে যায় তাহলে কষ্ট করে আসাটাই জলে গেল।
এদিকে ক্লাস টেনের কয়েকজন বারান্দার এক পাশে ফিসফিস করে কি যেন আলোচনা করছে। রনি নাইনের ফার্স্ট বয় হওয়ায় জানতে পারল, স্কুল ছুটি দিলে সবাইকে সোজা বাসায় চলে যেতে হবে। স্কুল ড্রেস পরে কাউকে যদি অন্য কোথাও দেখা যায় তাহলে তাকে সরাসরি টিসি দেওয়া হবে। কারণ কয়েকজন নাকি স্কুল ছুটির পর ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর আন্দোলনে যাবে। এজন্য টেনের মেয়েরা প্লেকার্ড লিখছে। এ খবর হেড স্যারের কাছে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। তিনি খুবই রাগান্বিত। তার কাছে সবার আগে স্টুডেন্টদের সেফটি। আন্দোলনে গিয়ে যদি কারো কোনো ক্ষতি হয় তাহলে সব দায়ভার তাকেই নিতে হবে।
টেনের ছেলেরা সিদ্ধান্ত নিলো স্কুল ছুটি হলেই তারা সবাই আন্দোলনে যোগ দেবে। সবাই একসাথে আন্দোলনে গেলে ক’জনকে হেড স্যার টিসি দিবেন!
রনি কি করবে ভাবছে। সে ভালো ছাত্র। এসব ঝামেলা থেকে ভালো ছাত্ররা দূরে থাকে। তাছাড়া হেড স্যারের আদেশ অমান্য করে সে যদি আন্দোলনে যায় তাহলে হেড স্যার নির্ঘাত ছোট চাচাকে অফিসে ঢেকে পাঠাবেন।
স্কুল ছুটি হয়ে গেল। টেনের ছেলেরা একজন আরেকজনের হাতে ধরে বিশাল এক মানব চর্তুভূজ বানিয়েছে। তাদের মাঝেমাঝে দু’একজন নাইনের ছেলেও আছে। চর্তুভূজ এর মাঝখানে মেয়েরা। তাদের হাতে প্লেকার্ড। সবচেয়ে বেশি যে প্লেকার্ডটি রনির চোখে পড়ল, তা হলো, ‘ডব ডধহঃ ঔঁংঃরপব’. আবার ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ লেখা প্লেকার্ড এর সংখ্যাও কম নয়। সবার সামনে চারজন বড় একটি জাতীয় পতাকা হাতে। রনি সবচেয়ে অবাক হলো আন্দোলনে মিতু মেয়েটাকে দেখে। তার জানামতে মেয়েটি তেলাপোকাও ভয় পায়। সেদিন তো গরমে ক্লাস রুমেই অজ্ঞান হয়ে গেল। এরপর তার বাবা এসে তাকে নিয়ে গেলেন। সেই মিতুর হাতে কিনা সবচেয়ে ভয়ংকর প্লেকার্ড, ‘রক্ত লাগলে রক্ত নাও, নিরাপদ সড়ক দাও’।
মিতুকে দেখে রনি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। সেও দুজনের হাত ধরে চর্তুভূজের একপাশে ঢুকে পড়ল। তাদের মিছিল স্কুলের গলি থেকে মেইন রোডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পুরোদমে স্লোগান চলছে। মিছিল নিয়ে মেইন রোডে আসতেই রনি দেখল অন্যান্য স্কুলের শিক্ষার্থীরাও মিছিল নিয়ে এগুচ্ছে। আজ তারা শহরের মূল পয়েন্ট দখলে নিবে। হঠাৎ একটা প্লেকার্ড দেখে রনির বুকে অন্যরকম এক সাহসের সঞ্চার হলো। প্লেকার্ডটিতে লেখা, যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ।
আচমকা কোথায় কি যেন একটা হলো। চারিদিকে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। একজনের পায়ের চাপায় রনির জুতা ছিড়ে গেছে। সে স্যান্ডেল ফেলে দৌড়ে দিতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় পড়ল। দুম দুম শব্দ হচ্ছে। গুলি নাকি টিয়ার গ্যাস? রনির বারুদের গন্ধ নাকে আসছে।
অনেকক্ষণ পর গোলমাল কিছু থামল। রনি হঠাৎ লক্ষ্য করল তার পাশে মিতু। মিতু তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, আরে তোমার কপালতো ফুলে গেছে। পড়ে গিয়েছিলে নাকি?
রনির লজ্জা লাগছে। মিতু নিশ্চয়ই সবাইকে বলে বেড়াবে, সেদিন এ সেকশনের রনি পড়ে গিয়ে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছিল।
মিতু রনিকে একটু দূরে ডাকল। তারা দুজন পাশাপাশি বসেছে। মিতু রনির মাথায় পানি ঢালছে। এরপর ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে কপাল মুছে দিলো।
রনি মিতুকে বলল, যেভাবে আন্দোলন শুরু হয়েছে নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ ছাড়া উপায় নেই। কি বলো?
‘নৌমন্ত্রী পদত্যাগ করে কি হবে? আমাদের প্রয়োজন নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা। যেন এদেশের প্রত্যেক শিক্ষার্থী নিরাপদে স্কুলে যেতে পারে।’
‘ঠিক আছে। এরসাথে কঠোর আইনও করতে হবে। এবং আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
রনির আন্দোলনের মাঝেও কেমন আনন্দ আনন্দ লাগছে। আজ এই আন্দোলন না হলে মিতু তার পাশে এভাবে বসতো না।
রনি মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে। মিতুর টিপ কপালের মাঝখান থেকে কিছুটা সরে গেছে। মনে হচ্ছে মেয়েটি লিপস্টিক খেয়ে ফেলছে। মেকআপেরও ঠিক নেই।
মিতু রনিকে তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, রনি কি হয়েছে তোমার?
রনি বলল, কিছু না তো।
আজকের মতো আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে। কাল আবার সবাই এই জায়গায় জড়ো হয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে। নয় দফা দাবী আদায়ের আগ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার হুঁশিয়ারি এসেছে।
সবাই যে যার বাসায় ফিরে যাচ্ছে। খালি পায়ে দাঁড়িয়ে রনি কি যেন ভাবছে। তার সবচেয়ে বড় ভাবনার জায়গা হলো, এদেশকে আবার বাঁচাতে হবে। একবার পূর্ব পুরুষেরা ১৯৭১ সালে দেশটাকে রক্ষা করেছিলেন তাদের আবার করতে হবে।
স্কুলে পড়া এইসব বাচ্চাদের দেশকে বাঁচানোর তেমন কোনো শক্তি নেই। তবে তাদের কাছে যে শক্তি আছে তা অন্য কারো কাছেই নেই। তা হলো, দেশের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।