আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে একটি ঐতিহাসিক সত্য
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ আগস্ট ২০২০, ৭:১৮ অপরাহ্ণ
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী:
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি এমন একটি ঐতিহাসিক উক্তি করেছেন, যা উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা অন্য কোনো মন্ত্রী উচ্চারণ করেননি, অথবা উচ্চারণ করতে সাহসী হননি। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মেহেরপুরের মুজিবনগর পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের কাছে এই উক্তি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের। আর চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অর্থনৈতিক।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে দেশের অনেকেই রাজনীতি করছে। এটা উদ্দেশ্যমূলক। চীন বাংলাদেশকে আট হাজারের বেশি পণ্যে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। এখন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দিতে যাচ্ছে। তা নিয়ে ভারত বিরক্ত হবে কেন? ভাইরাসমুক্ত হওয়ার জন্য তারাও চীনা ভ্যাকসিন নেবে। চীনও দেবে। এতে বিবাদ-বিসম্বাদের কী আছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত ও চীনের মধ্যে যে সমস্যা রয়েছে, এটা তাদের নিজস্ব সমস্যা। তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আগামী বছর আমরা ভারতকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করব। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় ছিল ভারতেরও বিজয়। ভারতের বিজয় ছিল আমাদেরও বিজয়।’ এর আগে কেউ এত স্পষ্ট করে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ব্যাখ্যা করেননি। ভারতের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক পাকিস্তানেরও। অথচ দুটি দেশই এই সম্পর্কের কথা স্বীকার করেনি। বরং ভারত ও পাকিস্তান দুটি দেশই পরস্পরকে পরস্পরের চিরশত্রু বলে চিহ্নিত করে এসেছে। বাংলাদেশও পাকিস্তানের অঙ্গীভূত প্রদেশ থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে পাঞ্জাবি শাসকরা শেখাতে চেয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের চিরশত্রু ভারত।
এই মিথ্যাটা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। দেখা গেল পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকরাই বাঙালির পরম শত্রু। তারা বাঙালির ঘরে ঘরে গণহত্যা চালিয়েছে। বেপরোয়া হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন চালিয়েছে সারাদেশে। অন্যদিকে, ভারত তার সীমান্ত খুলে দিয়েছে এক কোটি হিন্দু-মুসলমান বাঙালি শরণার্থীর জন্য। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিয়েছে। এই সহায়তা দিতে গিয়ে ২০ হাজার ভারতীয় সৈন্য আত্মদান করেছে। তার পরও যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সাহায্য দিতে প্রথম এগিয়ে এসেছে ভারত।
পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটব না। চার্চিল ব্রিটেন ও আমেরিকার সম্পর্ক নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, আমরা দুটি দেশ হতে পারি। কিন্তু সম্পর্কে আমরা ‘কাজিন’। এই সম্পর্ক বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানেরও। পাকিস্তান স্বীকার করে না। বাংলাদেশ এই ঐতিহাসিক সত্যটিকে স্বীকার করে বাস্তবতাকে মান্যতা দিয়েছে। যা দু’দেশের জন্যই কল্যাণকর হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে অনেক সমস্যা আছে। দু’ভাইয়ের মধ্যেও সম্পত্তিঘটিত এ ধরনের বিবাদ থাকে। সেজন্য কেউ দা-কুড়াল নিয়ে বিবাদে নামে না। নিজেদের মধ্যে অথবা সালিশ ডেকে মীমাংসা করে।
হাসিনা সরকার এই মীমাংসার পথ ধরেই ভারতের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেছে। যেসব সমস্যার দ্বিপক্ষীয় সমাধান হতে পারে না ভাবা হয়েছিল, সেগুলোর মীমাংসা হয়েছে। বাকি সমস্যাগুলোরও (তিস্তার পানিসহ) শান্তিপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সমাধানে উভয় দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান অনেক আগেই হয়ে যেত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তা হয়নি। এখন তার মনোভাব পাল্টেছে। আশা করা যায়, হাসিনা সরকারের বর্তমান মেয়াদেই বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক দুই কাজিনের মধ্যের সম্পর্কের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ হবে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বন্ধুপ্রতিম দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে ১৮ আগস্ট আকস্মিক ঢাকা সফরে এসেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিল্লির সহযোগিতার বার্তা পৌঁছে দিতে এসেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের বৈঠকও হয় দু’দেশের মধ্যে।
অনেকে বলেন, ভারতে বিজেপি হিন্দুত্ববাদী ভারত গড়ে তুলছে। এই সাম্প্রদায়িক ভারতের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সম্পর্ক টেকসই হবে না। এই অভিমত যারা সমর্থন করেন, সেই বন্ধুদের বলি, বর্তমান বিশ্বে নীতিভিত্তিক মিত্রতা নেই, আছে স্বার্থভিত্তিক মিত্রতা। তাই বিশ্ব রাজনীতিতে বাঘ আর গরুতে এক ঘাটে জলপান করছে। অতীতের নীতিভিত্তিক মিত্রতার যুগ বর্তমানেও থাকলে রাশিয়ার পুতিনের সাহায্য নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন- এই অভিযোগ উঠত না এবং সৌদি আরবের মতো কট্টর মুসলিম দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে মিতালি পাতাত না।
গান্ধী-নেহরুর ভারত ৭৩ বছরের পুরোনো গণতান্ত্রিক দেশ। এই দেশে যদি হিন্দুত্ববাদ মাথা গজায় তা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব ভারতের মানুষের। বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের রাজত্বকালে যখন উগ্র ইসলামিস্ট তালেবানের মাথা তোলার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তখন তা প্রতিহত করার দায়িত্ব বাংলাদেশের মানুষের ছিল। পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেউ নাক গলাবে না- এই নীতি অনুসরণ করে নেহরুর আমলে ভারত-চীন মৈত্রীও হয়েছিল। একালে ব্রিটেনের লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার এবং আমেরিকার রিপাবলিকান (কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল পার্টি) পার্টির জর্জ বুশ জুনিয়র হাতে মিলিয়েছিলেন।
শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে, বাংলাদেশ থেকে জিহাদিস্টরা যেন ভারতে অনুপ্রবেশ না করে। অন্যদিকে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিজেপির দ্বারা উৎসাহিত হয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে যেন কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা না তোলে। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের অভাব-অভিযোগের সুযোগ নিয়ে সম্প্রতি তাদের সরকারবিরোধী উস্কানিদানের জন্য একাধিক গোষ্ঠী মাথা তোলার চেষ্টা করছে। ভারত থেকে তাদের উৎসাহ দান করা হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে। আমার ধারণা, এ ব্যাপারে মোদি সরকারকে জানানো হলে তারা হিন্দুত্ববাদের যত বড় পৃষ্ঠপোষক হন, বাংলাদেশে তা রপ্তানির চেষ্টা করবেন না। মোদি জানেন, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশই হচ্ছে ভারতের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশে ক্ষমতায় এলে ভারতের জন্য কী অঘটন ঘটে, তা তারা বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে দেখেছেন।
চীনের সঙ্গে ভারতের প্রধান সমস্যা হিমালয়ের সীমান্ত এবং হিমালয় সন্নিহিত একাধিক রাজ্য নিয়ে। সীমান্ত নিয়ে সমস্যা রাশিয়ার সঙ্গেও চীনের রয়েছে। তা নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। বর্তমানে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক বাড়ছে। ভারতও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। এই সম্পর্ক বাড়ছে বাংলাদেশের সঙ্গেও। তাতে ভারতের আপত্তি করার কিছু নেই। আপত্তি হবে বাংলাদেশে চীন যদি সামরিক ঘাঁটি বানাতে চায়। সে সম্ভাবনা আদৌ নেই। আমেরিকার সঙ্গে যারা অতীতে সামরিক চুক্তি করেছে, তাদের অবস্থা দেখার পর হাসিনা সরকার কারও সঙ্গেই কোনো সামরিক চুক্তি করতে যাবে- এমন সম্ভাবনা নেই। নীতিগতভাবে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন সামরিক চুক্তিবিরোধী। আমেরিকার সিয়াটো চুক্তি থেকে তিনি বাংলাদেশকে বাইরে রেখেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে চীনের অন্যরকম ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু চীনের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। নয়া চীনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী চু এন লাইয়ের তিনি ছিলেন ব্যক্তিগত বন্ধু। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তো আজকের নয়, প্রায় হাজার বছরের- হুয়েন সাং প্রমুখ চীনা পর্যটক সেই কবে সুদূর চীন থেকে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসেছিলেন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পাওয়া যায় তাদের লেখা বিবরণে। বর্তমানকালেও চীনের সঙ্গে প্রথম মৈত্রী স্থাপন করেন পাকিস্তানের বাঙালি প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
তার আমন্ত্রণে চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চু এন লাই পঞ্চাশের দশকে ঢাকা সফরে এসেছিলেন। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ঢাকায় তাকে যে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, তা ঢাকার জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। তখনও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের দৃঢ় বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। মাঝখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন তার নিজস্ব ভ্রান্ত ধারণা থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান যে প্রচার করেছিল ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দিলে চীন হিমালয় এলাকা থেকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, চীন তা করেনি। সে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি।
বাংলাদেশ সম্পর্কে চীনের ভ্রান্ত ধারণা এখন দূর হয়েছে। চীন এখন বাংলাদেশের এক শ্রেষ্ঠ ট্রেড পার্টনার। শেখ হাসিনা চীন সফর করেছেন। চীনের শীর্ষ নেতারাও বাংলাদেশ সফর করেছেন। চীনের সঙ্গে আমাদের এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারে না, নষ্ট করেনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথাটাই এত স্পষ্ট করে বলেছেন। কারও কারও বলার ইচ্ছা থাকলেও বলেননি। পাছে ভয়, তাকে ভারতের দালাল বলা হয়।
হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্রনীতি লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, এই নীতি ভারসাম্যের নীতি। এই নীতি ক্রমশই সাফল্য অর্জন করছে এবং বাংলাদেশের বন্ধুর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ড. আব্দুল মোমেন, যাকে আমি দীর্ঘকাল ধরে চিনি, তিনি দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে আরও সফল করে তুলুন- এটা আমার কামনা। একটি সত্য কথা অত্যন্ত স্পষ্ট করে সাহসের সঙ্গে বলার জন্য তাকে আমার অভিনন্দন।
[লন্ডন, ১৯ আগস্ট, বুধবার, ২০২০]