শুভ প্রবারণা পূর্ণিমার আলোকে বিশ্বশান্তি
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ অক্টোবর ২০২০, ১১:৩০ পূর্বাহ্ণ
সীবলী বডুয়া: আজ ১ লা অক্টোবর বৃহস্পতিবার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারনা পূর্ণীমা তথা আশ্বিনী পূর্ণিমা। সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধ সম্প্রদায় আজ নানা আচার ও অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে নিজ গৃহে ও বিহারে উৎসবটি উদ্যাপন করবে।
পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত শেষে আজ এই প্রবারণা তিথী। প্রবারণা হলো আত্মশুদ্ধি ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণের অনুষ্ঠান। এই প্রবারণা পূর্ণীমার পরদিন থেকে এক মাস ধরে দেশের প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে শুরু হবে শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব।
প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে ফ্রান্স, বাংলাদেশসহ সাড়া পৃথিবীর সকল থেরবাদা বৌদ্ধ রাষ্ট্রে সকাল থেকে শুরু হয় ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, প্রভাত ফেরি, বুদ্ধপূজাসহ, ভিক্ষুসংঘের উদ্দশ্যে পি-দান, মঙ্গল সুত্র পাঠ, পঞ্চশীল ও অষ্টাঙ্গ উপসোথ শীল গ্রহণ, মহা সঙ্ঘদান, অতিথি আপ্যায়ন, পবিত্র ত্রিপিটক থেকে পাঠ, আলোচনা সভা, প্রদীপ পূজা, বিশ্ব শান্তি কামনায় সন্মিলিত বুদ্ধোপসনা, বুদ্ধ কীর্তন, আলোকসজ্জা, ফানুস ওড়ানো প্রভৃতি।
সংস্কৃত প্রবারণা শব্দ থেকে পালি প্রবারণা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। বস্তুত: প্রবারণা শব্দের অর্থটা হচ্ছে প্রকৃষ্ট রূপে ধারণ করা, গ্রহণ করা, মনের ভেতরের রাগ, দ্বেষ, মোহ ও অশুভ চিন্তা-চেতনাকে বর্জন করা। ত্যাগের মাধ্যমেই পরিশীলিত ও পরিশুদ্ধ হওয়া, দান, শীল, ভাবনা, সমাধি ও প্রজ্ঞা উৎপাদনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি হওয়া। আত্ম সংযম করা, স্বীয় দোষ-ত্রুটি স্বীকার করা এবং এক ভিক্ষু অপর ভিক্ষুর কাছে আত্মনিবেদনের মাধ্যমে সংশোধিত হওয়াই হল প্রবারণা।
এখন সারা বিশ্বে চলছে বৈশ্বিক করোনাকালীন সংকটময় পরিস্থিতি। সাথে সাথে সারা বিশ্বে বিভিন্ন জাতি, গৌষ্ঠি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নিয়ে চলছে নানা ভেদাভেদ, হত্যা , নিধন যজ্ঞ। ফলস্বরূপ বিভিন্ন দেশে ধর্মমতালম্বীদের মধ্য প্রতিনিয়ত চলছে হানাহানি, ধর্ষণ, অত্যাচার , গুম, অনাচার, দমন- নিপীড়ন , নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিপন্ন মানবতার মত লোমহর্ষক নারকীয় ঘটনা। হিংসায় উন্মুক্ত এই অশান্ত বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে মহাকারণীক তথাগত গৌতম বুদ্ধের অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হতে হবে এবং সামাজিক , পারিবারিক , রাষ্ট্রীয় , বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও পরিবেশকে সুন্দর, শান্ত ও স্থিতিশীল রাখতে হবে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটা একটা কঠীন কাজ। তবে নি:সন্দেহে বলা যায়- মাহাকারুণীক গৌতম বুদ্ধের ধর্ম, পঞ্চনীতি, চতুরার্য্য সত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গসহ সকল আদর্শ ও নীতিকে সমুন্নত রাখতে পারলেই প্রতিটি দেশে শান্তি ফিরে আসবে।
প্রবারণা পূর্ণীমার তাৎপর্য : তথাগত গৌতম বুদ্ধ শুভ আষাঢ়ী পূর্ণীমা তিথিতে বারানসীর অন্তর্গত সারানাথের মৃগধাবে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুসংঘের কাছেই সর্বপ্রথম ধর্মচক্র সুত্র দেশনা করেন। এই ধর্মদেশনা শ্রবন করে কৌ-ান্যোর ধর্মচক্ষু উৎপন্ন হওয়ার খবর একত্রিশ লোকভূমিতে পৌঁছার সাথে সাথে সাধুবাদ ধ্বনিতে সারাবিশ্ব আলোকিত হয়েছিল। এবং কৌটি দেবতা, ব্রহ্মা একইসাথে শ্রোতাপন্ন হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক ঘটনার পরই তথাগত গৌতম ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস শুরু করেন। এই বর্ষাবাসকালীন সময়ে তাঁর শিষ্যগণ গভীর মনোযোগ সহকারে বুদ্ধের নিকট ধর্ম শ্রবণ করে বিমুক্তি দর্শন ও আর্যসত্য লাভ করেন। এরপর বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বললেন, হে ভিক্ষুগন তোমরা সবাই মৃত্যন্জয়ী, তোমরা আজ হতেই দিকে দিকে বিচরণ কর। দেব-মানবের কল্যানে তথাগতের অনন্ত জীবনে সাধনা লব্ধ অমিয় বাণী প্রচার করতে থাকো।তবে একসাথে দু’জন যাবে না। আমি উরুবেলার উদ্দেশ্য যাত্রা করছি। সেদিন ছিল শুভ আশ্বিনী পূর্ণীমা; যাকে আজ প্রবারণা পূর্ণীমা বলে আখ্যায়িত করি। বুদ্ধ ক্রমাগত ৬ বছর মগদ রাজ্যে মধ্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে ধর্ম প্রচার করে সপ্তম বর্ষে তাঁর মাতৃদেবীকে বিমুক্তি দানের উদ্দেশ্যে গ- বৃক্ষমূলে যমজ ঋদ্ধি প্রদর্শন করে তাবতিংশ দেবলোকে দেবরাজ পয়ান্ত কম্বল সিংহাসনে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করেন এবং তিন মাস যাবত অভিধর্ম দেশনা করে মাতৃদেবীকে বিমুক্তি দান করেন। এরপর ভগবান বুদ্ধ প্রবারণা পূর্ণীমার শুভলগ্নে ভারতের সাংকাশ্য নগরে স্বর্গ থেকে অবতরনকালে দেবতা ও মানুষের মিলন ঘটেছিল এবং সোনা, রূপা ও মুক্তার তিনটি সিঁড়ি তৈরী হয়েছিল। তথাগত বুদ্ধ স্বয়ং মনিমুক্তার সিঁড়িতে, মহাব্রহ্মা সোনার আর দেবরাজ ইন্দ্র রৌপ্যর সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গ থেকে অবতরণ করেছিলেন। এবং স্বর্গের চুলামনি চৈত্যোর মধ্য তথাগত বুদ্ধের চুল ধাতু রয়েছে। এসব কারণে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নর-নারীগণ প্রতি বছর এই শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা তিথিতে আকাশে ফানুসবাতি প্রজ্জ্বলিত করে আসছে। তাছাড়া পাবেল্য ভিক্ষুসংঘকে উপলক্ষ্য করে তথাগত বুদ্ধ কঠিন চীবর দানের বিধান প্রবর্তন করেন।
সবাইকে শুভ প্রবারণা পূর্ণীমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। সকল প্রাণি দুঃখহীন, ভয়হীন, শত্রুহীন ও রোগহীন হোক।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
সীবলী বডুয়া, সভাপতি- ইন্টারন্যাশনাল বুড্ডিস্ট কাউন্সিল ওব ফ্রান্স
ডিএস/এমসি
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন
- 32Shares