স্মৃতিচারণে আজ রাধারমণ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ৪:৪৪ অপরাহ্ণ
বিথী রানী নাথ: বাংলা সাহিত্যিক, সাধক কবি, বৈঞ্চব বাউল, ধামালি নৃত্য-এর প্রবর্তক রাধারমণ দত্ত । আজ কেনো জানি উনাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে বড্ড মন চাইছে ।
রাধারমণ দত্ত:- সাধক কবি রাধা রমণ দত্ত জন্মসূত্রে পুরকায়স্থ । উনার জন্ম হয়েছে ১৮৩৩ সালে। এবার আসি সাধকের ব্যাক্তিগত জীবনে,অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ঐতিহাসিক গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে পাওয়া যায়,রাধারমণ দত্তের পুর্ব পুরুষ ছিলেন শ্রীহট্ট বা সিলেট অঞ্চলের পঞ্চখণ্ডে ত্রিপুরাধিপতি ‘ধর্ম ফাঁ’ কর্তৃক সপ্তম শতকে মিথিলা হতে আনিত প্রসিদ্ধ পাঁচ ব্রাহ্মণের মধ্যে ‘আনন্দ শাস্ত্রী’ নামক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব । সাধকের পিতার নাম রাধামাধব দত্ত ও মা সুবর্ণা দেবী। স্ত্রী গুণময়ী দেবী।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের নিকটস্থ কেশবপুর গ্রামে রাধারমণ দত্তের বাড়ি ।কবি রাধারমণের পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপাসনার প্রধান অবলম্বন সংগীতের সংগে তার পরিচয় ছিল শৈশব থেকেই ।
সংগীতানুরাগীদের কাছে এই সাধক রাধারমণ বলেই পরিচিত । এই বৈঞ্চব বাউল বাংলা লোকসংগীতের পুরোধা লোককবি। কৃষ্ণ বিরহের আকূতি আর না-পাওয়ার ব্যথা কিংবা সব পেয়েও না-পাওয়ার কষ্ট তাকে সাধকে পরিণত করেছে। তিনি দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, ভজন, ধামাইলসহ নানা ধরনের হাজার হাজার গান রচনা করে গেছেন।
কালক্রমে তিনি একজন স্বভাবকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। রচনা করেন হাজার হাজার বাউল গান । লিখেছেন কয়েক শ ধামাইল গান। ধামাইল গান সমবেত নারীকন্ঠে বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত হয়। বিশেষত সিলেট, কাছাড়, ত্রিপুরা ও ময়মসিংহ অঞ্চলে একসময় এর প্রচলন খুব বেশি ছিল। রাধারমণ দত্ত একাধারে গীতিকার, সুরকার, ও শিল্পী ছিলেন। রাধারমণ একজন কৃঞ্চপ্রেমিক ছিলেন। কৃঞ্চবিরহে তিনি লিখেছেন অসংখ্য গান। তার মধ্যে বিখ্যাত দুটি গান হচ্ছে:-
“ | কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া । অন্তরে তুষেরই অনল জ্বলে গইয়া গইয়া ।। ঘর বাঁধলাম প্রাণবন্ধের সনে কত কথা ছিল মনে গো । ভাঙ্গিল আদরের জোড়া কোন জন বাদী হইয়া ।। কার ফলন্ত গাছ উখারিলাম কারে পুত্রশোকে গালি দিলাম গো । না জানি কোন অভিশাপে এমন গেল হইয়া ।। কথা ছিল সঙ্গে নিব সঙ্গে আমায় নাহি নিল গো । রাধারমণ ভবে রইল জিতে মরা হইয়া । |
” |
“ | ভ্রমর কইয়ো গিয়া, শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে, ভ্রমর কইয়ো গিয়া ।। ভ্রমর রে, কইয়ো কইয়ো কইয়োরে ভ্রমর, কৃষ্ণরে বুঝাইয়া মুই রাধা মইরা যাইমু কৃষ্ণ হারা হইয়ারে, ভ্রমর কইয়ো গিয়া।। ভ্রমর রে, আগে যদি জানতামরে ভ্রমর, যাইবারে ছাড়িয়া মাথার কেশও দুই’ভাগ করি রাখিতাম বান্দিয়ারে, ভ্রমর কইয়ো গিয়া।। ভ্রমর রে, ভাইবে রাধারমন বলে শোনরে কালিয়া নিব্বা ছিলো মনের আগুন কে দিলা জ্বালাইয়ারে, ভ্রমর কইয়ো গিয়া।। |
” |
তিনি বাল্যাবধি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও ধর্মানুরাগী ছিলেন। শাস্ত্রীয় পুস্তকাদীর চর্চা ও সাধু সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে তিনি শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যদি নানা মত ও পথের সঙ্গে পিরিচিত হন। কবির সংসারজীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় নি। শুধু জানা যায়, রাধারমণ-গুণময় দেবীর ৪ ছেলে ছিল। তাদের নাম- রাজবিহারী দত্ত, নদীয়াবিহারী দত্ত, রসিকবিহারী দত্ত ও বিপিনবিহারী দত্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় একমাত্র পুত্র বিপিনবিহারী দত্ত ছাড়া বাকি ৩ পুত্র এবং স্ত্রী গুণময় দেবী অকালে মারা যান। স্ত্রী ও পুত্রদের পরলোক গমনে কবি রাধারমণ দত্ত সংসারজীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন। ১২৯০ বঙ্গাব্দে ৫০ বছর বয়সে কবি চলে যান মৌলভীবাজার জেলাধীন ঢেউপাশা গ্রামে সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি তার কাছে শিষ্যত্ব লাভ করেন। শুরু হয় কবির বৈরাগ্য জীবন। আরম্ভ করেন সাধনা। গৃহত্যাগ করে জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের পাশে একটি আশ্রম তৈরি করেন। এখানে চলে তার সাধন-ভজন। কবি নিজেই গেয়েছেন:-
শ্যামের বাঁশিরে ঘরের বাহির করলে আমারে
যে যন্ত্রণা বনে যাওয়া গৃহে থাকা না লয় মনে ॥
নলুয়ার হাওরের আশ্রম দিবা রাত্র সাধনা ও ইষ্ট নামে মগ্ন এবং অসংখ্য ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। ধ্যান মগ্ন অবস্হায় তিনি গান রচনা করে গেয়ে যেতেন। ভক্তরা শুনে শুনে তা স্মৃতিতে ধরে রাখত এবং পরে তা লিখে নিত।
সাধকের রচিত ধামাইল গান সিলেট ও ভারতের বাঙ্গালীদের কাছে পরম আদরের ধন। শত শত গানের ভান্ডার রাধারমণ ।
প্রাণ সখী রে ওই শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে
বংশী বাজায় কে রে সখী বংশী বাজায় কে
আমার মাথার বেণী খুইল্যা দিমু তারে আইনা দে
প্রাণ সখী রে ওই শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে
যে পথ দিয়ে বাজায় বাঁশি সে পথ দিয়ে যায়
সোনার নূপুর পরে পায়ে
আমার নাকের নোলক খুইল্যা দিব সেইনা পথের গায়ে
আমার গলার হার গড়িয়ে দেব সেই না পথের গায়ে
যদি হার জড়িয়ে পড়ে যায়
প্রাণ সখী রে ওই শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে
যার বাঁশি এমন, সে বা কেম্ জানিস যদি বল
সখি করিস না তো ছল, আমার মন বড় চঞ্চল
আমার প্রাণ বলে তার বাঁশি জানে আমার চোখে জল
প্রাণ সখী রে ওই শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে
করলা বাঁশের-ও বাঁশি ছিদ্র গোটা ছয়
বাঁশি কতই কথা কয়
নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি রহনো না যায়
ঘরে রহনো না যায়
প্রাণ সখী রে ওই শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে
কোন বা ঝাড়ের বাঁশের বাঁশি, ঝাড়ের লাগাল পাই।
জড়ে পেড়ে উগরাইয়া, সায়রে ভাসাই ॥
ভাইবে রাধারমণ বলে, শুন গো ধনি রাই।
জলে গেলে হবে দেখা, ঠাকুর কানাই ॥
প্রাণ সখী রে ওই শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে
আমরা অনেক সময় এই সাধককে নিয়ে অনেক কিছু জানতে চাই,তার জন্য আমাদের একটা র্নিদিষ্ট সংগ্রাহকের প্রয়োজন হয় ।বিভিন্ন সংগ্রাহকদের মতে, রাধারমণে গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও উপরে। সাধক রাধারমণের গানের বেশ কিছু গানের বই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য প্রথমে রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কলিকাতা থেকে বাউল কবি রাধারমণ নামে ৮৯৮ টি গান নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মোহাম্মদ মনসুর উদ্দীন তার হারামনি গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে রাধারমণের ৫১ টি গান অন্তর্ভুক্ত করেন। সিলেটের মোদন মোহন কলেজের সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘রাধারমণ সঙ্গীত’ নামে চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষনের সংগ্রীহিত একটি গ্রন্থ ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকার অ্যার্ডন পাবলিকেন্স প্রকাশ করেছে সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত ‘অগ্রন্থিত রাধারমণ’ বইটি। দীর্ঘকাল পর রাধারমণের অগ্রন্থিত গান সংগ্রহ হওয়ায় এ গ্রন্থটি বোদ্ধামহলে প্রশংসা কুড়ায়। এছাড়া গুরুসদয় দত্ত, নির্মলেন্দু ভৌমিক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, কেতকী রঞ্জন গুণ, মুহাম্মদ আব্দুল হাই, হুছন আলী, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, নরেশ চন্দ্র পাল, যামিনী কান্ত র্শমা, মুহম্মদ আসদ্দর আলী, মাহমুদা খাতুন, ডঃ বিজন বিহারী পুরকাস্থ, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, মোঃ আজিজুল হক চুন্নু, জাহানারা খাতুন, নরেন্দ্র কুমার দত্ত চৌধুরী, অধ্যাপক সুধীর চন্দ্র পাল, অধ্যাপক দেওয়ান মোঃ আজরফ, নন্দলাল শর্মা, শামসুল করিম কয়েস, শুভেন্দু ইমামসহ আরও অনেক বিদগ্ধজন রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহ করেছেন।
বৈঞ্চব বাউল, ধামালি নৃত্য-এর প্রবর্তক রাধারমণ দত্ত শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে।
কিন্ত কালজয়ী এই সাধক চিরকাল বাঙ্গালীর অন্তরে বেঁচে থাকবেন। জয় হোক বাংলা গানের,জয় হোক শ্রী রাধারমণ দত্তের।