‘ভাষা দিবসের অঙ্গীকার, নারীর প্রতি নোংরা শব্দ করি পরিহার’
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:৩৯ অপরাহ্ণ
ফারজানা ইসলাম ভূঁইয়া: স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।আজও দ্বের্থহীন কণ্ঠে আমরা বলতে পারি না যে বাংলাদেশের বুকে নারী এবং পুরুষের জীবনে স্বাধীনতা সমান ভাবে নিরোপিত হয়েছে। এই বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে পুরুষের যেমন ত্যাগ রয়েছে তেমনি রয়েছে নারীদের অসামান্য ত্যাগের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যত আন্দোলন হয়েছে , যুদ্ধ হয়েছে প্রতিটি সংগ্রামে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে মায়ের মুখের ভাষার জন্য দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল ।সেই বাংলা ভাষাতেই নানা ভাবে নারী কে করা হয় অবমাননা। হ্যাঁ কেবল বাংলা ভাষার কিছু শব্দ দিয়ে নারী কে জন্মের পর থেকে নানা বয়সে নানা সময় হতে হয় অপমানিত, লাঞ্চিত।
শব্দ বা ভাষার কোন লৈঙ্গিক পরিচয় থাকার কথা নয়। কিন্তু নিত্যদিন শুধু নারীকে অবমাননার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে নানা নোংরা শব্দ। যেদিন থেকে নারী সচেতন হতে শিখেছে, যেদিন থেকে নারী উড়তে শিখেছে আকাশ পথে, বলতে শিখেছে না বলা কথা ঠিক সেইদিনও নারী শুনেছে নানা ধরনের নোংরা শব্দ। নানা অমর্যাদাকর শব্দ দিয়ে পথ রোধ করতে চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পথ- ঘাট, স্কুল- কলেজ, খেলার মাঠ ও অফিস- আদালতে নারীকে শব্দের আঘাতে জর্জরিত হতে দেখা যায়। জীবনে কোনদিন নোংরা শব্দে জব্দ হয়নি এমন নারী বাংলাদেশে একজনও পাওয়া যাবে না। হয়তো পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে নারীকে নিয়ে নোংরা কথা বলাটা একটি সাধারন নিয়ম।শুধু যে বাহিরের পরিবেশে এমনটা হয় তা নয় সাহিত্যের ভাষাতেও রয়েছে নারীর প্রতি অবমাননাকর হাজারো শব্দ।বাংলাদেশের নারীর কিছু স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলোকে অতিরঞ্জিত কিংবা হাস্যরসাত্মক ভাবে উপস্থাপন করে অনেকেই ক্ষণিকের বিনোদন পেয়ে থাকে।কিন্তু আমরা সচেতনভাবে কখনো ভেবে দেখেছি কি এইসব শব্দ চয়ন ক্ষণিকের জন্য পাঠকের মনে বিনোদনের উদ্রেক করলেও দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নারীর সামাজিক অবস্থানের উপর।যা একটি সমাজ কাঠামোতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।
আমরা হয়তো লক্ষ্য করলে দেখবো যে এইসব কৌতুকে নারীকে যতটা হাস্যরসাত্মক করে তোলে ধরা হয় বাস্তবচিত্র কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো।বাস্তবতা হলো দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ নারীই পারিবারিক নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে অনেক নারী সচেতনতার অভাবে নিজেই বুঝতে পারেননা এইসব হাস্যরস নারীর আত্মসম্মানের জন্য কতটা অবমাননাকর।তাই এইসব বেমানান চিত্রায়নের মধ্যে অদ্ভূত কোন আনন্দ আছে কিনা তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে বলে মনে করি।তাছাড়া হাস্যরস কিংবা কৌতুকে মজা থাকবে—এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু মজার বিষয়বস্তু যখন নারীর সৌন্দর্য কিংবা সহজাত আচার-আচরণকে বিদ্রুপাত্মকভাবে উপস্থাপন করে, তখন তাকে নিছক মজা বলে মেনে নেওয়ার কোনো কারণ আছে বলেও মনে করি না।
এবার একটু ঘুরে তাকানো যাক,শব্দ বা ভাষা দিয়ে নারীকে জব্দ করার সংস্কৃতি কিন্তু একদিনে নির্মান হয়নি।নারী জন্মের পর থেকে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।তাই এটি বন্ধ করতে হলে এর পেছনের কারনগুলোও আমাদের জানতে হবে। জানতে হবে একজন নারী কে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কত ভাবে ছোট করে দেখা হয় বা রাখতে চেষ্টা করা হয় পুরুষশাসিত এই সমাজে। একজন নারী মূলত একটি মেয়ে শিশু ।মেয়ে শিশু কথাটি শুনে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে। শিশু তো শিশুই –একটি মানব সন্তানের আবার ছেলে বা মেয়ে কি? ছেলে শিশু বা মেয়ে শিশু হিসেবে আলাদা কেন তাহলে? উত্তর খুবই সহজ কারন মেয়ে শিশু মানব সন্তান হিসেবে জন্ম গ্রহন করে বটে , কিন্তু জন্মের পর থেকেই সে ভিন্ন আচরণের শিকার হয়। উপেক্ষা ,অবজ্ঞা, বৈষম্য- বঞ্চনা একটা সময় মেয়ে শিশুর জীবনকে করে তোলে বিষময়।সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মেয়ে শিশুর টিকে থাকা ও বিকাশের পথে রয়েছে অজস্র প্রতিবন্ধকতা । জন্ম মুহূর্ত থেকেই ক্রমাগত বঞ্চিত হতে থাকে মেয়ে শিশুরা। আর সেই বঞ্চনা ধীরে ধীরে তাকে ঠেলে দেয় শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার দিকে।
নারী ও মেয়ে শিশুদের নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারন হলো তাদের প্রতি সমাজের অত্যন্ত নেতিবাচক ও অমর্যাদাকর মনোভাব বিরাজমান। যার মূল কথা হলো পুরুষের প্রাধান্য ও নারীর অধস্তনতা। এই মানসিকতা আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো শুধু পুরুষই নয় অনেক নারীও এ মনোভাব পোষণ করেন। ফলে সামাজিক আচার- আচরণ , রীতি- নীতি, এমনকি সাহিত্য- কৃষ্টিতেও তাদের হেয় করে দেখানো হয়। নারী ও মেয়ে শিশুদের প্রতি নিপীড়ন ও বঞ্চনা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিরই ফলাফল।
সাদা চোখে দেখলে মনে হতে পারে বাংলাদেশের মেয়েরা না জানি কতদূর এগিয়েছে কিন্তু অল্প দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের দেশের বেশিরভাগ মেয়ে সংসারে এখনো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।মেয়েদেরকে জীবনের শুরু থেকেই সব জায়গায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবেই গণ্য করা হয়। আমরা যদি আমাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া লক্ষ্য করি দেখবো যে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নারী-পুরুষের সামাজিক লিঙ্গ (Gander) নির্মাণ করা হয়। নারী ও পুরুষের প্রতি এই বৈষম্য মূলক মনোভাবের পেছনে রয়েছে বাস্তবতা বিবর্জিত ধ্যান- ধারনা ও প্রচলিত কতগুলো মিথ্যা বিশ্বাস। যা সমাজকে শেখায় নারী মানে নির্বোধ, পুরুষ হলো সাহসী ইত্যাদি।আর পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষতান্ত্রিক এই সকল দর্শন আর চর্চার মধ্যে বেড়ে ওঠা একটি মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিত্বও প্রভাবিত হয় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা। তাই ছোট থেকেই একজন মেয়ে বা নারীর আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদাও অনেক ক্ষেত্রে পূর্ণরূপে বিকশিত হয় না।
চরম সত্যি এবং একটি দুঃখজনক বিষয় হলো একুশ শতকেও নারীকে জব্দ করা হয় রক্ত দিয়ে কেনা বাংলা ভাষাতেই। বাংলার বুকে প্রতিটি ঘরে আজও নারীরা কিছু নোংরা শব্দ শোনে নীরবে চোখের জল ফেলে। সেই সব নোংরা শব্দের ব্যবহার সব বয়সের, সব শ্রেণীর , সব পেশাতেই বিরাজমান।আমরা জানি বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক অবস্থান এমনিতেই নড়বড়ে। সব মিলিয়ে এক ভীষণ দুঃসময়ের মধ্যদিয়ে পথ চলে বাংলাদেশের নারী সমাজ।সমাজে নানা অমর্যাদাকর শব্দে জব্দ হয়ে সীমাহীন যন্ত্রণা নিয়ে কেমন করে বেঁচে থাকে একজন নারীই কেবল তা অনুধাবন করতে পারেন।নারীকে ভাষা বা অমর্যাদাকর শব্দ দিয়ে হেয় প্রতিপন্নভাবে উপস্থাপন করার পেছনে কেবল পুরুষরাই দায়ী তা কিন্তু নয়।এটি আমাদের পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক দর্শন ও তার চর্চা।তাই এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে।তাই সমাজের প্রাথমিক স্তর পরিবার থেকেই অবমাননা বন্ধে কাজ করতে হবে। নারীর সম্মানজনক সামাজিক অবস্থান নিশ্চিত করতে হলে অবিলম্বে নারীর প্রতি অবমাননাকর সব বক্তব্য, মন্তব্য, ঠাট্টা-তামাশা, কৌতুক , অমর্যাদাকর শব্দ বলা এবং লেখা বন্ধ করতে হবে।কারণ, এসব শব্দ এবং ভাষা চর্চার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।প্রজন্মের পর প্রজন্ম নারীর প্রতি এই সব অবমাননাকর শব্দ আর ভাষা নারীকে কোনভাবেই সম্মানজনক স্থানে জায়গা দিতে পারেনা।একুশ শতকে এসে এই সত্যটিই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছে যেন।তাই নারীর প্রতি নোংরা শব্দ বা ভাষার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে দেশ সেই উৎসবের মধ্যে বেড়ে ওঠা থেকে অন্তত নারীদের মুক্তি হোক। যেই ভাষাই ছিল একটা সময় আমাদের ঐক্যের মূল প্রেরণা সেই ভাষার কোন শব্দ কিংবা বাক্য দিয়ে আমরা নারী পুরুষের মধ্যে যেন আর কোন বিভেদের দেয়াল সৃষ্টি না করি সেই প্রতিজ্ঞা হোক প্রতিটি মানুষের।।তাই আসুন, ভাষার ব্যবহারে নিজেরা সচেতন হই এবং আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিভেদ নয় ঐক্যের শিক্ষা দিতে সচেষ্ট হই।একুশ শতকের ভাষা দিবসে এটিই যেন হয় প্রাণের অঙ্গীকার।