
শাহীন আহমেদ : ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ। বন্যার পানিতে ডুবেছে জেলা সবচেয়ে উঁচু স্থানটিও। পানি আর মানুষের অসহায়ত্বের হাহাকার ছাড়া সুনামগঞ্জের আর কিছুই চোখে পড়ছে না। স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছেন, জীবদ্দশায় তারা এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেননি। ১৯৮৮ ও ২০০৪ সালের বন্যার চাইতে ২০২২ সালের বন্যা সারাজীবন মনে থাকবে। শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার কবলে সিলেট-সুনামগঞ্জ বানভাসীদের বাঁচার আর্তনাদ
আবহাওয়া অধিদফতর থেকে বলা হচ্ছে, সুনামগঞ্জে আগামী তিন দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। কমপক্ষে সাত দিন বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করবে। এতে জেলার মানুষের দুর্ভোগ সহসায় কাটছে না। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের দুশ্চিন্তার পরিসর ক্রমেই বাড়ছে।
এদিকে বন্যার একের পর সিলেট নগরীতে বাসাবাড়ি ডুবে যাচ্ছে।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দোলারবাজার ইউনিয়নের সুরুজ আলম বলেন আমার বয়স ৫৩ কিন্তু আমার জীবনে এমন ভয়াবহ বন্যা দেখিনি। ১৯৮৮ ও ২০০৪ সালের বন্যার ২০২২ সালের বন্যা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।
গোয়াইনঘাটের বাসিন্দা হালিমা বেগম বলেন আমার জীবনে এমন ভয়াবহ দেখিনি, ২০০৪ সালের বন্যায় আমার ঘরে হাঁটুপানি হয়েছে কিন্তু এবার বন্যায় আমার ঘরে সাতার পানি হয়েছে। আমার গরু বন্যায় মারা যাওয়া আশষ্কা।

সুনামগঞ্জ শহরের উকিলপাড়ার বাসিন্দা মোনাজ্জির আলী মামুন বলেন, ‘শত বছরের বাসিন্দা আমরা, ঘরে হাঁটু সমান পানি এর আগে কখনও হয়নি। আমাদের বাড়িতে পানি উঠলে, শহরের অনেক বাড়িতেই কোমর থেকে হাঁটু সমান পানি হওয়ার কথা।’
এই মহল্লার আলিমাবাগ মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা ওসমান গণি বলেন, ‘মসজিদের নিচের তলায় হাঁটু সমান পানি। আছরের নামাজ দোতলায় আদায় করেছেন মুসুল্লিরা।’
শহরের তেঘরিয়ার বাসিন্দা সেলিম আহমদ বলেন, ‘আমার বসতঘরে এর আগে কোনও বন্যায় পানি ওঠেনি, এবার পানি উঠেছে। পশ্চিম তেঘরিয়া বা বড়পাড়ার অনেক বসতঘরে বুক সমান পানি হয়েছে। সড়কে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শহরেই হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।’
এদিকে, বন্যার পানির সঙ্গে ভেসে ভেসে ঘরে-বাড়িতে ঢুকছে ময়লা। একে বন্যার পানি, অন্যদিকে পচা দুর্গন্ধ। হাঁটা চলার অনুপযোগী হয়ে উঠেছে সুনামগঞ্জ শহর। বন্যার পানির সঙ্গে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের তেঘরিয়া, বড়পাড়া, বিহারী পয়েন্ট, হাজীপাড়া, নতুন পাড়াসহ প্রায় সব জায়গায় ময়লা ঢুকছে। এতে ভোগান্তির মাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। ময়লার কারণে অসুখ-বিসুখের মাত্রাও বাড়তে পারে।
শহরের বড়পাড়া এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দীর্ঘদিনের ময়লার স্তূপ পানির সঙ্গে ভেসে এসে আটকে গেছে। এখন এগুলোকে ছোট ছোট করে কেটে দিচ্ছি যেন স্রোতের তোড়ে ভেসে যায়।’
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, ‘পানিতে সব ভরে গেছে। এখন এগুলো নিয়ে কিছু করার নেই। ত্রাণ দিয়ে মানুষের পাশে আছি এখন। পানি কমলেও ময়লাও চলে যাবে।’
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া, ‘আগামী ৪৮ ঘণ্টা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে সোমবার পর্যন্ত পানির স্তর বাড়তে থাকবে। আশা করি, এরপর থেকে পানি কমতে শুরু করবে। এ কারণে সিলেট বিভাগে অন্তত আগামী সাত দিন বন্যা অব্যাহত থাকবে।’
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘বন্যার ভয়াবহতা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বন্যা তথ্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ছাতকে ১৭টি, দোয়ারাবাজারে ১৬টি ও সুনামগঞ্জ সদরে ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যা দুর্গতদের মধ্যে বাড়িঘরে থাকার অনুপযোগী সবাকেই আশ্রয়কেন্দ্রে আনা, শুকনো খাবারসহ সাময়িক খাদ্য সহায়তা দিয়ে সহায়তায় করবে প্রশাসন।
এদিকে সন্ধ্যার পর রাজ্যের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল সুনামগঞ্জ শহরে। দুই দিন ধরে জেলা বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন। নেই মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক। ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ। মোমবাতি আর জ্বালানি তেলের সংকটে অনেক বাসায় জ্বলেনি আলোও। এর মধ্যে টানা বৃষ্টি ও বজ্রপাত ছিল। সব মিলিয়ে ভুতুড়ে পরিস্থিতি। এ অবস্থায় গতকাল শুক্রবার বিভীষিকাময় একটি রাত পার করল বন্যার পানিতে সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সুনামগঞ্জের মানুষ।
আজ শনিবার সকালে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা গেছে। কমবেশি একই চিত্র ছিল জেলার ১২টি উপজেলাতেও। বন্যাকবলিত লোজজন জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জে গত বুধবার থেকে তৃতীয় দফায় বন্যা দেখা দেয়। বর্তমানে জেলার সব উপজেলাই বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার অবস্থা শোচনীয়। এখানে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষের বিহীন রয়েছে।