গোয়াইনঘাটে বর্বরতা: পেট্রোল ঢেলে ঘরে আগুন, বের হওয়ার পর হত্যা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০২২, ১২:০৩ অপরাহ্ণ
দৈনিকসিলেট ডেস্ক : আগেই দেয়া হয়েছিল রাস্তায় ব্যারিকেড। এরপর বাড়ি ঘেরাও করে শতাধিক লোক। ভয়ে ঘরের ভেতরে আশ্রয় নেন বাড়ির লোকজন। এ সময় পেট্রোল ঢেলে দেয়া হয় ঘরের চারদিকে। দেয়া হয় আগুন। ঘরের ভেতরেই ছিলেন আব্দুল কাদির। জানালা দিয়ে তিনি যখন বাইরে আসেন তখনই দাঁড়িয়ে থাকা হামলাকারীরা তাকে ধরে ফেলে। একটি কাঁঠাল গাছের নিচে নিয়ে শুইয়ে দেয় মাটিতে। এরপর গলায় চালায় ধারালো রামদা। এমন লোমহর্ষক, বর্বর ও পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছে সিলেটের গোয়াইনঘাটের দুর্গম দক্ষিণ লাবু গ্রামে।
ঘটনায় হতবাক এলাকাবাসী। পুলিশ নামে অভিযানে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২ জনকে। পুলিশের ৫টি টিম অভিযানে রয়েছে। পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে লাবু গ্রাম। তবে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের আতঙ্ক কাটেনি। কাদিরের পিতা আব্দুল খালিক, মা হাসিনা বেগম, স্ত্রী সাবিনা বেগম ও চাচাতো ভাই শহীদ আহমদকে নির্মমভাবে কোপানো হয়েছে। তারা বর্তমানে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ঘটনা শুক্রবার রাতের। গোয়াইনঘাটের প্রত্যন্ত গ্রাম দক্ষিণ লাবু গ্রাম। সদর ইউনিয়নে ওই গ্রামের অবস্থান হলেও সীমান্তবর্তী গ্রাম হওয়ার কারণে সেখানে অপরাধীদের সংখ্যা বেশি। সীমান্তে চোরাচালান সহ নানা ঘটনায় জড়িত ওই গ্রামের মানুষ। প্রায় চার বছর আগে গোয়াইন গ্রামের নুরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছিল ওই গ্রামে। আর ওই ঘটনাটি সংগঠিত হয়েছিল আব্দুল কাদিরের বাড়ির নিকটবর্তী স্থানে। এ কারণে নুরুল হত্যার ঘটনায় কাদির সহ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষকে আসামি করা হয়।
এ মামলার চার্জশিট প্রদানের পর এখন আদালতে মামলাটি চলমান রয়েছে। গ্রামের কয়েকজন মহিলা জানিয়েছেন- নুরুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে গ্রামের লোকজন আসামি হওয়ার পর সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে ওই মামলা চালাচ্ছিলেন। এই মামলা দেখভাল করতো নিহত আব্দুল কাদির সহ তার পরিবারের সদস্যরা। সম্প্রতি মামলার খরচ বহন নিয়ে গ্রামের আতাফুল, শামসুদ্দিন, লুৎফুর সহ কয়েকজনের সঙ্গে বিরোধ চলছিল আব্দুল খালিক ও তার ছেলে আব্দুল কাদিরের। এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে তারা মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। গ্রামের ভেতরে উত্তেজনা দেখা দেয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় গোয়াইনঘাট সদর থেকে খেয়াঘাটে ফিরেন আব্দুল কাদির। ঘাটে নামার পর মামলার খরচ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গ্রামের কয়েকজন লোকের সঙ্গে তার কথাকাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে আতাফুল, শামসুদ্দিন, লুৎফুর, কনা মিয়া, মফিজ উদ্দিন, আব্দুল রহিমদ, আপ্তাফুল সহ কয়েকজন আব্দুল কাদিরকে ঘাট এলাকায় মারধর করে। পাল্টা হামলাও করে আব্দুল কাদির ও তার লোকজন। এ ঘটনার পর আব্দুল কাদির দক্ষিণ লাবু গ্রামের নিজ বাড়িতে চলে যায়। এদিকে- ঘটনার পর রাত ৮টার দিকে আতাফুল, শামসুদ্দিন, লুৎফুর, কনা মিয়া, মফিজ উদ্দিন, আব্দুল রহিমদ, আপ্তাফুলের নেতৃত্বে গ্রামের শতাধিক মানুষ আব্দুল কাদিরের বাড়ি ঘেরাও করে। তার আগে তারা গ্রামের পূর্বদিকে পরগণা মাদ্রাসা এলাকায় সড়কে ব্যারিকেড দেয়। কাউকে ওই গ্রামের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পশ্চিম দিকে তারা কামালের বাড়ির সামনে ব্যারিকেড দেয়।
লাঠিসোঁটা নিয়ে কিছুসংখ্যক মানুষ ওখানেও পাহারায় বসে। আর বেশির ভাগ লোক গিয়ে ঘেরাও করে আব্দুল কাদিরের বাড়ি। এ সময় আব্দুল কাদির, তার পিতা আব্দুল খালিক সহ পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে ছিলেন। বাড়ি ঘেরাও করার পর আব্দুল কাদির ও তার পরিবারের সদস্যরা দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরেই অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে হামলাকারী লোকজন বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঘরের চারদিকে পেট্রোল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করে। এতে করে গোটা বাড়িতেই দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। ঘরের ভেতর থেকে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করলেও বাড়ির দু’দিকে ব্যারিকেড থাকার কারণে কেউ ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেননি। বাড়ির বাসিন্দা আব্দুস সালাম জানিয়েছেন- ঘরের চারদিকে আগুন থাকায় জানালা খুলে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে প্রথমে বের হন আব্দুল কাদির। এ সময় হামলাকারীরা তাকে ধরে ফেলে। এক পর্যায়ে কাঁঠাল গাছের নিচে নিয়ে মাটিতে শুয়ে দেয় এবং রামদা দিয়ে জবাই করে। এ দৃশ্য দেখে কাদিরের পিতা আব্দুল খালিক, মা হাসিনা বেগম ও স্ত্রী সাবিনা বেগম দরোজা খুলে দৌড়ে আসেন। তাদেরকেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। এক পর্যায়ে তার চোখের সামনেই আব্দুল কাদিরকে গলা কেটে হত্যা করে ঘাতকরা। তিনি জানান- একদিকে ঘরে আগুন জ্বলছিল, অন্যদিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে কোপানো হচ্ছিল।
বাঁচার জন্য চিৎকার করা হলেও কেউ এগিয়ে আসতে পারেননি। ফলে দূর থেকে দাঁড়িয়ে স্থানীয় লোকজন ঘটনাটি অবলোকন করছিলেন। স্কুলছাত্রী মাছুমা বেগম জানিয়েছে- ঘটনার সময় মনে হয়েছিল কিয়ামত নেমে এসেছিল। গোটা বাড়িতেই দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুন। আর যারাই আগুন থেকে বাঁচতে ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে। এতে ঘটনাস্থলে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত কাদিরের পিতা, মাতা, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সাবিনা ও বোন নাজমা গুরুতর আহত হন। খবর পেয়ে প্রায় একঘণ্টা পর পুলিশ এলে হামলাকারীরা চলে যায়। পুলিশ আসার পর আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। পুলিশ নিহত কাদিরের লাশ উদ্ধার করেছে। হাসপাতালে থাকা কাদিরের স্বজনরা জানিয়েছেন- ‘ওরা এসে ঘরের চারদিকে পেট্রোল ঢেলে দেয়। এরপর তারা বাইরে পাহারা বসায়। ঘরের ভেতরে আগুন জ্বলার আসার পর আব্দুল কাদির সবাইকে বাচাতে একাই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমরা পিছু পিছু বের হয়ে দেখি ওরা আব্দুল কাদিরকে জবাই করছে।
আমরা বার বার হাতে-পায়ে ধরে জীবন ভিক্ষা চাইলেও ওদের মন গলেনি। উল্টো ওরা আমাদেরকেও কোপায়’। এদিকে- ঘটনার নির্মমতা জানার পর গোয়াইনঘাট থানা পুলিশের কয়েকটি টিম তাৎক্ষণিক অভিযান শুরু করে। পুলিশের একটি টিমকে মোতায়েন করা হয় নিহত আব্দুল কাদিরের বাড়িতে। রাত থেকে শুরু হওয়া অভিযানে গতকাল বিকাল পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গোয়াইনঘাট থানার ওসি কেএম নজরুল ইসলাম শনিবার বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘পুলিশের ৫টি টিম অভিযানে রয়েছে। হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এর বাইরে সাদা পোশাকে পুলিশের কয়েকটি টিম রয়েছে।’ তিনি জানান- ‘ইতিমধ্যে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ এ ঘটনায় দোষীদের ছাড় দেবে না। এলাকায় যাতে পরিবেশ স্বাভাবিক থাকে সে কারণে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’ এদিকে- গতকাল দুপুরে সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজ আফজাল ও শাহরিয়ার বিন সালেহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজ আফজাল জানিয়েছেন- এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। যারা প্রকৃত আসামি তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।
এদিকে- সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বিকালে কাদিরের লাশ পৌঁছে বাড়িতে। বাদ আসর স্থানীয় পরগণা বাজার মাদ্রাসায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লাশ দাফন করা হয়েছে। গ্রেপ্তার যারা: পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ও বসতঘরে আগুন দেয়ার প্রধান আসামি লুৎফুরসহ ১২ জনকে আটক করে এবং অপরাধের সঙ্গে ব্যবহৃত অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে- লাবু গ্রামের আতাউর রহমানের ছেলে শাহীন, হাসান রেজার ছেলে লুৎফুর, আবুল খায়েরের ছেলে বেলায়েত হোসেন, সোনা মিয়ার ছেলে কাজী কামাল, আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুন নূর, কুতুব উদ্দিনের ছেলে জসীম উদ্দিন, আব্দুস সোবাহানের ছেলে হাবিবুল্লাহ মিসবাহ, আব্দুস সালামের ছেলে অলিউল্লাহ, আব্বাস উদ্দিনের ছেলে আলী হোসেন ও আলম হোসেন। বাকিদের নাম জানা যায়নি।
মানবজমিন/ডিএস