অবসাদ ? চিকিৎসার নতুন উপায়!
দৈনিক সিলেট ডট কম
দৈনিকসিলেটডেস্ক: মস্তিষ্কে কম সেরোটোনিনের মাত্রাকেই অবসাদের কারণ বলে ধরে নেয়া হয়৷ কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, এর সঙ্গে নিউরোট্রান্সমিটারের বিশেষ সম্পর্ক নেই৷ তাহলে অবসাদের আসল কারণ কী? নতুন স্টাডি কী বলছে?
আপনারা নিশ্চয়ই অবসাদের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা তত্ত্বের কথা শুনেছেন৷ এই তত্ত্ব বলে, মস্তিষ্কে ফাইভ-এইচটি নামে পরিচিত নিউরোট্রান্সমিটার সেরোটোনিন কমে গেলে অবসাদ তৈরি হয়৷
নিউরোট্রান্সমিটার হলো এক ধরনের সিগন্যালিং কেমিক্যাল বা সংকেতবাহী রাসায়নিক, যার মাধ্যমে একটি স্নায়ুকোষ বা নিউরন অন্য নিউরনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে৷ এই তত্ত্বটি ষাটের দশকে প্রথম জানা যায়৷ সেইসময় ডাক্তাররা মেজাজ ভাল রাখার জন্য ‘আইপ্রোনিয়াজিড’ ওষুধ ব্যবহার করতেন৷ তারা বিশ্বাস করেছিলেন, এটি মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়৷
বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে জানেন, এই তত্ত্বটি আসলে অতি সরলীকরণ৷
অবসাদের সঙ্গে সেরোটোনিন জড়িত নয়
একাধিক গবেষণাপত্রের মূল রিভিউগুলি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, এমন ‘কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই’ যে কম সেরোটোনিন মানেই তা অবসাদ ডেকে আনতে পারে৷
৩৬১টি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের ‘পিয়ার রিভিউ’ থেকে পাওয়া প্রমাণ বলছে, রক্তে সেরোটোনিনের মাত্রার সঙ্গে অবসাদের কোনো যোগসূত্র নেই৷ এদিকে অবসাদগ্রস্ত মানুষের মস্তিষ্কের সেরোটোনিন রিসেপটরের সঙ্গে অবসাদ নেই এমন মানুষের মস্তিষ্কের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাননি গবেষকেরাও ৷ তাহলে?
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মাইকেল ব্লুমফিল্ড এই গবেষণায় জড়িত নন৷ তিনি বলেন, ‘‘অবসাদের বিভিন্ন উপসর্গ রয়েছে৷ আমি অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করেছি৷ অবসাদের সমস্ত কারণ সেরোটোনিনের মতো সাধারণ একটি রাসায়নিকের ভারসাম্যহীনতার কারণে হয় এমনটা তারা মনে করেন না৷”
কম সেরোটোনিনের মাত্রার কারণে শুধু অবসাদ হয় এমনটা আদৌ নয়–এই সিদ্ধান্তে অনেক বিশেষজ্ঞ যেমন অবাক হননি৷ আবার অবসাদের সঙ্গে সেরোটোনিনের কোনো সম্পর্কই নেই, এ সিদ্ধান্তের সঙ্গেও অনেকে সহমত নন৷
ব্লুমফিল্ড বলেন, ‘‘কিছু নির্দিষ্ট ধরনের অবসাদে আক্রান্ত কিছু ব্যক্তির জন্য সেরোটোনিন সিস্টেমে পরিবর্তনের ভূমিকা রয়েছে এমনটা হতে পারে৷ এই রিভিউগুলির সমস্যা হলো, এটি অবসাদের সমস্যাকে একটি নির্দিষ্ট ব্যাধি বলে দেখছে, কিন্তু জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর কোনো মানে নেই৷
অবসাদের চিকিৎসায় অ্যান্টিডিপ্রেসান্টস এত কার্যকর নয়?
গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে প্রোজাকের মতো এসএসআরআই অ্যান্টিডিপ্রেসান্টস, যা মস্তিষ্কে ‘সেরোটোনিন আপটেক’কে ব্লক করে কাজ করে৷ এটি অবসাদের চিকিত্সায় ব্যবহার করা উচিত নয়৷
একটি গবেষণা ইঙ্গিত করেছে, অ্যান্টিডিপ্রেসান্টস অবসাদের চিকিত্সার ক্ষেত্রেখুব একটা কার্যকর নয়, বিশেষ করে যাদের মাঝারি বা কম-তীব্র অবসাদ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এ ওষুধ কাজ করে না৷
গবেষণাপত্র পড়ে যারা রিভিউ লিখেছেন, তারা বলছেন, রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা তত্ত্বে বিশ্বাসী মানুষ চিকিত্সা বন্ধে নিরুৎসাহিত হতে পারেন, ফলে আজীবন এই ওষুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারেন৷
যুক্তরাজ্যের ইউসিএল জেনেটিক্স ইনস্টিটিউটের সাম্মানিক অধ্যাপক ডেভিড কুর্টিস এই রিভিউর শেষ অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, গুরুতর অবসাদে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যাতে যথাযথ চিকিত্সা করেন, চিকিৎসা করতে নিরুৎসাহিত না হন, তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ৷ তার কথায়, অবসাদে ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতার কিছু অস্বাভাবিকতা রয়েছে৷ আমরা এখনও জানি না যে এটি কী? তবে অ্যান্টিডিপ্রেসান্টগুলি গুরুতর অবসাদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকর৷”
কেন অবসাদ তাহলে?
নতুন গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে সেরোটোনিন অবসাদের কারণ নয়৷ তাহলে এর কারণ কী? কোনো বিকল্প ব্যাখ্যা না মিললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবসাদ একটি জটিল অবস্থা যার একাধিক কারণ রয়েছে৷
জীবনের নেতিবাচক ঘটনাগুলি এবং আমরা কীভাবে তার সঙ্গে মোকাবেলা করি–অবসাদের সঙ্গে তার একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে৷ পাশাপাশি স্ট্রেস অবসাদের একটি মূল ‘ট্রিগার’ হিসাবে পরিচিত৷
জার্মানির মিউনিখে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের মনোস্তত্ত্ববিদ পাট্রিসিয়া ফোনসেকা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অবসাদ বা হতাশার ক্ষেত্রে বড়সড় প্রভাব ফেলে জীবনের একাধিক ঘটনা৷ তবে জেনেটিক কারণগুলির প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ৷ একটি বিশেষ জিনগত প্রবণতার কারণ জীবনের দুঃখজনক ঘটনাগুলি অবসাদের সূত্রপাত ঘটাতে পারে৷”
বর্তমান তত্ত্বগুলি সেরোটোনিনের মতো একক নিউরোট্রান্সমিটারের ব্যাখ্যা থেকে আরো খানিকটা এগিয়েছে৷ স্টাডিতে দেখা হচ্ছে, অবসাদ কীভাবে মস্তিষ্কের জটিল নেটওয়ার্কগুলিকে পরিবর্তন করে দেয় যা আবেগ এবং মানসিক চাপ বা স্ট্রেস তৈরি করে৷
এই তত্ত্বগুলিতে মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা এবং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের মতো অঞ্চলগুলির মূল ভূমিকা রয়েছে৷আবেগগুলি অ্যামিগডালা অংশে তৈরি হয়, এগুলি পরে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে যায়, যেখানে আবেগের অর্থ বোঝার কাজগুলি হয়৷ গবেষণা বলছে, অবসাদে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অ্যামিগডালার পরিমাণ কমেছে এবং অ্যামিগডালা এবং কর্টেক্সের মধ্যে সংযোগ কমেছে৷
গবেষণায় দেখা গেছে যে ম্যাজিক মাশরুমে পাওয়া সাইলোসাইবিন অবসাদ কমায়
গবেষণায় দেখা গেছে যে ম্যাজিক মাশরুমে পাওয়া সাইলোসাইবিন অবসাদ কমায়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্টেক্স আবেগকে আরো নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে তাই অবসাদ তৈরি হয়, বিশেষ করে যে আবেগ খারাপ স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত, তা আরো অবসাদ তৈরি করে৷
দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এটিতে আরো বেশি প্রভাব ফেলতে পারে৷চাপের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে৷ নইলে আগের দুর্বলতাগুলি বেরিয়ে আসতে বাধ্য৷
অবসাদের চিকিত্সার নতুন উপায়
অ্যান্টিডিপ্রেসান্টের মিশ্র কার্যকারিতার সঙ্গে বিজ্ঞানীরা অবসাদ সারানোর আরো নতুন উপায় খুঁজছেন৷
এ চিকিৎসায় কেটামাইন এবং সাইলোসাইবিন মাশরুমের মতো ওষুধের ইতিবাচক ফলাফলের প্রমাণ বেড়েই চলেছে৷ সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সাইলোসাইবিন অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট ড্রাগ এসসিটালোপ্রামের চেয়ে বেশি কার্যকর৷
ব্রেন-ইমেজিং গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই ওষুধগুলি মস্তিষ্কে সংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে৷ পুরানো আবেগগুলিকে নতুনভাবে পুনঃপ্রক্রিয়া করতে সাহায্য করে এই ওষুধ, পাশাপাশি অবসাদের প্রবণতা কমাতে মস্তিষ্ককে সাহায্য করে৷
ফোনসেকা জানান, অবসাদের চিকিৎসায় ‘নন-ফার্মাকোলজিক্যাল’ চিকিৎসার কার্যকারিতার উপরও জোর দেয়া হচ্ছে৷
তার কথায়, ‘‘এর মধ্যে সাইকোথেরাপি থাকতে পারে, ফলে মানসিক চাপ এবং হতাশাকে দক্ষ হাতে সামাল দেয়া যাবে৷ সাইকোথেরাপিতে কোনো ব্যক্তির অবসাদের কারণ খুঁজে বের করার সময় রয়েছে৷ তারা রোগ সম্পর্কে জানতে পারে, অসহায় পরিস্থিতিতে পড়ার পরিবর্তে জীবনের কঠিন সময়ের মোকাবেলা করতে পারে৷”
সূত্র: ডয়েচে ভেলে