ইসলাম ন্যায়সংগত বিচারের নিশ্চয়তা দেয়
বিচারব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা

মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
ইসলাম ন্যায়সংগত বিচারের নিশ্চয়তা দেয়। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ, ‘ন্যায়সংগত বিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৪২)
কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক ইসলামী আইনে পরিমার্জনের প্রয়োজন হয় না।
মানবরচিত আইন সংশোধন পরিমার্জনের ধারায় আবর্তিত হয়। ভারতের সংবিধান সংশোধন হয়েছে ৯৩ বার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩০ বার। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫০ বছরের ইতিহাসে ১৭টি সংশোধনী হয়েছে।
ইসলামের বিঘোষিত নীতি ও পৃথিবীতে প্রিয় নবী (সা.) শুভাগমনের বাস্তবতা প্রসঙ্গে তাঁরই (সা.) ভাষায় পবিত্র কোরআনে আছে, ‘তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি। ’ (সুরা শুরা, আয়াত : ১৫)
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন তা সাধ্যমতো ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে করবে। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৮)
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে প্রিয় নবী (সা.) ও সাহাবি যুগের অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। ফাতেমা নামের এক সম্ভ্রান্ত মহিলার চুরিরদণ্ড মাফের সুপারিশ শুনে প্রিয় নবী (সা.) উচ্চারণ, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি এ জন্যই ধ্বংস হয়েছে যে তাদের সাধারণ লোকেরা চুরি করলে শাস্তি কার্যকর করত। কিন্তু সম্ভ্রান্তরা চুরি করলে তাদের কোনো শাস্তি দিত না। সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ। যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম। ’ (বুখারি)।
ন্যায়-কল্যাণের গুরুত্ব বোঝাতে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘বিচারক তিন শ্রেণির। দুই শ্রেণির বিচারক জাহান্নামি এবং এক শ্রেণির বিচারক জান্নাতি। যিনি জান্নাতে যাবেন তিনি হলেন ওই বিচারক, যিনি হকবুঝে সে অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করেন। দ্বিতীয় প্রকার ওই বিচারক, যিনি সত্যকে জানেন; কিন্তু বিচার-ফয়সালায় জুলুম করেন, তিনি জাহান্নামি। তৃতীয় প্রকার বিচারক তিনি, যিনি অজ্ঞতার ওপর মানুষের বিচার-ফয়সালা করেন, তিনি জাহান্নামি। (মিশকাত)
ইসলামে বিচারকের কর্মপদ্ধতি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেমন :
রাগ-অনুরাগের বশবর্তী না হওয়া
চিকিৎসা বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রাগের মুহূর্তে রক্ত উত্তপ্ত থাকে, মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায় এবং তখন ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করতে পারে না। ইসলামে রাগান্বিত অবস্থায় বিচার-ফয়সালা করতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবদুর রহমান ইবনু আবু বাকরা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী করিম (স.)-কে বলতে শুনেছি, কোনো বিচারক রাগান্বিত অবস্থায় দুজনের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করবে না। ’ (মুসলিম)
বাদী-বিবাদীর বক্তব্য শোনা
ইসলামী ব্যবস্থায় বাদী-বিবাদীর বক্তব্য শোনার পর রায় দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এক পক্ষের বক্তব্যের ভিত্তিতে রায় নিষিদ্ধ। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, তোমার কাছে যখন দুজন লোক বিচারের জন্য আবেদন করে, তখন তুমি দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে না শুনেই প্রথম পক্ষের কথার ওপর ভিত্তি করে রায় দেবে না। ’ (তিরমিজি)
রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘তোমার কাছে যখন দুজন লোক বিচারের জন্য আসে, তখন তুমি তাদের মাঝে ফয়সালা করবে না, যতক্ষণ না দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য শুনবে, যেভাবে তুমি প্রথম পক্ষের কথা শুনেছ। যখন তুমি এরূপ করবে, তখন তোমার কাছে ফয়সালার বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে। ’ (মুসনাদ আহমদ)
অভিযুক্ত ও অভিযোগকারীর প্রতি সমব্যবহার
বিচারকার্যে ধনী-গরিব, ছোট-বড়, উঁচু-নিচুর মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যাবে না। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষ এমন এক শ উটের মতো, যাদের মধ্য থেকে তুমি একটিকেও বাহনের উপযোগী পাবে না। ’ (বুখারি)
অর্থাৎ ইসলামে সব মানুষই সমান। মানুষের মধ্যে আশরাফ-আতরাফ সবার মর্যাদা সমান।
বিদ্বেষ পোষণ না করা
শত্রুতা, বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে বিচারের বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআনের হুঁশিয়ারি, ‘কোনো গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। ’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ০৮)
দুর্নীতিমুক্ত বিচার
ন্যায়বিচারের অন্যতম অন্তরায় দুর্নীতি। ঘুষ বাণিজ্য ইসলামে হারাম। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত, ‘বিচারের ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহীতা ও ঘুষ প্রদানকারীকে রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। ’ (তিরমিজি)
বস্তুত ন্যায় ও সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান মানবতা, নৈতিকতার পরিপন্থী। শিক্ষিত, দায়িত্বশীলরা যখন লোভ-লাভের স্বার্থে-শর্তে অন্যায় সিদ্ধান্ত দেন তখন বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠে অসহায়, নিঃস্পৃহ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতসমূহকে তার যথার্থ হকদারদের কাছে পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়বিচার করবে। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৮)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ
কাপাসিয়া, গাজীপুর