শনিবার সাংবাদিক ও গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীর ১৫তম প্রয়াণ দিবস

দৈনিকসিলেটডটকম
সজল ঘোষ: দেশ বরেণ্য সাংবাদিক ও গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীর ১৫তম প্রয়াণ দিবস আগামী ১৯ নভেম্বর শনিবার। বরেণ্য মানুষ সঞ্জীব চৌধুরী ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চলে যান তিনি না ফেরার দেশে।
সঞ্জীব চৌধুরী আজীবন তাঁর রচিত গানে, কবিতায়, সাংবাদিকতায়- প্রগতিশীলতা, মানবতা ও গণতন্ত্রের কথা বলে গেছেন সাহসী উচ্চারণে। তিনি গানে, কবিতায় বলে গেছেন, দুঃখী-দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের মর্মবেদনার কথামালা। ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো চাঁদ, আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিলো চাঁদ’, ‘রিকশা কেন আস্তে চলে না’, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘ওই কান্না ভেজা আকাশ আমার ভালো লাগে না’, ‘দুঃখ ব্যথায় মুখটা যে নীল’, ও ‘সমুদ্র সন্তান’সহ শতশত জননন্দিত গানের গায়ক, ফিচার সাংবাদিকতার পথিকৃত ও পাঠক সংগঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা সঞ্জীব চৌধুরী।
২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর। তখন রাত প্রায় ১২টা। সবার স্রোত অ্যাপলো হাসপাতালের দিকে। শোকের মাতম হাসপাতালের করিডোরে। বাতাস ভারী। এদিক সেদিক ছুটছে সবাই। মস্তিষ্কে রক্তক্ষণ তার। লাখো লাখো ভক্তের প্রার্থনা। মুখে হাত ঠেসে কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু কিছুতেই কিছু নয়। ওপারে সঞ্জীব চৌধুরী চলে গেলেন মাত্র ৪৩ বছর ১০ মাস ২৪ দিন বয়সে। তখন লাখো লাখো ভক্তের চোখে অশ্রুপ্লাবন বয়ে যায়। সে কান্না এখনো থামেনি। এ কান্না থামবে না কখনো।
প্রিয় স্ত্রী শিল্পী নাসরীন এবং ৫ বছরের একমাত্র মেয়ে সন্তান কিংবদন্তীকে নিয়ে ছিল সাজানো সুখের সংসার তার। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা ননী গোপাল চৌধুরী ও মা প্রভাশিনী চৌধুরী। নয় ভাই বোনের মধ্যে সপ্তম সঞ্জীব চৌধুরীর ছেলেবেলা কেটেছে হবিগঞ্জেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে দুর্দান্ত ফলাফলের পর প্রবেশ করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আঙিনায়। গণযোগাযাগ ও সাংবাদিকতায় পড়াশোনার পর পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতা। এত অল্প সময়ের মধ্যে জগৎ মঞ্চ, রাজপথ, বন্ধুত্ব, গান-গিটার আর আড্ডা ছেড়ে চলে গেলেন ক্ষণজন্মা মানুষটি। হলেন দলছুট। সঞ্জীব চৌধুরী ১৯৯১ সালে যোগ দিলেন দৈনিক আজকের কাগজে। সৃষ্টিশীলতার নতুন অধ্যায় উন্মোচন করলেন। কয়েক দশকের কাটখোট্টা ভাষার অবসান। নতুন বৈচিত্র্য, নতুন স্বাদ। পাঠকদের সঙ্গে এশুরু হয় নিবিড় যোগাযোগ। যোগদেন তিনি দৈনিক ভোরের কাগজে। এবার সরাসরি পাঠকদের প্লাটফর্ম তৈরির করলেন। গঠন করলেন ভোরের কাগজ পাঠক ফোরাম। এবারও হলেন তিনি ব্যাপকভাবে সফল। ‘মেলা’ শিরোনামে একটি নিয়মিত সাপ্তাহিক বিনোদন পাতাও চালু করেন। পাঠক মহলে সাড়া জাগে ব্যাপক। এরপর ২০০৫-এ দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় চিফ ফিচার এডিটর হিসেবে নিযুক্ত করেন নিজেকে। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায়ও তিনি কাজ করেন।
রাজনীতি, কবিতা, সঙ্গীত, সাংবাদিকতা আর কী প্রয়োজন একজন সৃষ্টিশীল মানুষের। নাম ডাকের সঙ্গে সঙ্গে ভক্ত জুটল বহু। হলেন আড্ডার মধ্যমণি। সঞ্জীব, সঞ্জীবদা কয়েক সম্বোধনে চেনেন সবাই। শুধু তাই নয়, গল্প, নতুন স্বপ্ন, বা সাপোর্ট থেকে সবকিছুতেই এ মানুষ হলেন বটবৃক্ষ। ১৯৯৬ সালে সঙ্গীত শিল্পী বাপ্পা মজুমদারকে নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ডদল। নাম ‘দলছুট’। নিজের কবিতা আর চিন্তা-ভাবনার খেলা ‘দলছুট’। ১৯৯৭ সালে প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’। তারপর ২০০০ সালে ‘হৃদয়পুর’ অ্যালবাম দিয়ে লাখো শ্রোতার হৃদয়ের অন্ত:পুরে। ২০০২ ও ২০০৭ সালে আসে ‘দলছুট’-এর আরো দুই অ্যালবাম ‘আকাশচুরি’ ও ‘জোছনাবিহার’। বরাবরের মতোই সাফল্য সব সময় ছিলো ‘দলছুটের’। মাঝে বেরোয় সঞ্জীব চৌধুরীর একমাত্র একক অ্যালবাম ‘স্বপ্নবাজি’ সহ বেশ কিছু মিক্সড অ্যালবাম।
বেহিসেবি, জীবনে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয় তার অভিনয় আঙিনায়। একজন সাংবাদিক, কবি, ছড়াকার, লেখক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, অভিনেতার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। এই ভালো মানুষটির জীবন বর্ণাঢ্য ও রঙিন। তাঁর জীবনের নীতি-নৈতিকতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তাঁর আদর্শকে ধারণ করে সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক সমাজ গড়তে হবে। তাহলেই প্রিয় সঞ্জীব চৌধুরীর আত্মা স্বর্গ সোধায় মহিমান্বিত হয়ে যাবে সহজেই।
‘আমি তোমাকেই বলে দেবো,’ ‘বায়োস্কোপ’, ‘অন্তর্জাতিক ভিক্ষা সঙ্গীত’, ‘বাজি’, ‘নৌকা ভ্রমন’, ‘আমার সন্তান’, ‘আকাশচুর’, ‘তারাভরা রাত’, ‘কার ছবি নেই’, ‘ছিলো গান, ছিলো প্রাণ’, ‘গিটার’, ‘সানগ্লাস’, ‘ভরদুপুর’, ‘ভালো থাকুক’ ‘বেঁচে থাকুক’, ‘হৃদয়ের দাবি’, ‘কিংবদন্তী’, ‘অচীন বৃক্ষ’, ‘নতজানু’, ‘পোড়ে সিগারেট’, ‘সাদা ময়লা,’ ‘সমুদ্র সন্তান,’ ‘জোছনা বিহার,’ ‘তোমার ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও,’ ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ,’ ও ‘স্বপ্নবাজি’, ‘মনে পড়ে’, সহ প্রভৃতি কালজয়ী গানের সাথে জড়িয়ে আছে সঞ্জীব চৌধুরীর নাম। ‘গাড়ি চলে না, চলে না রে’ ‘কোন মিস্তরি নাও বানাইছে’ গানগুলো গেয়ে বাংলা লোকগানকে তিনি নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছেন। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় ও জননন্দিত ব্যান্ড ‘দলছুট’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সঞ্জীব চৌধুরীর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘রাশপ্রিন্ট’। এ গ্রন্থটি বাংলা একাডেমি হতে বের হয়। গ্রন্থটি পাঠক মহলে সাড়া জাগায়।
২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সঞ্জীব চৌধুরীর জন্মদিন উপলক্ষে ‘আজব প্রকাশ’ ‘তোমাকেই বলে দেব’ শিরোনামে জয় শাহরিয়ারের সংকলন ও সম্পাদনায় একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। গ্রন্থটিতে সঞ্জীব চৌধুরীর অনেক অনেক গান ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। গুণী মানুষ সঞ্জীব চৌধুরীর মৃত্যু নেই। তিনি আছেন এবং থাকবেন অগণিত মানুষের হৃদয় মন্দিরে। তার কর্মকীর্তি অনন্তকাল তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
এদিকে, দেশ বরেণ্য সাংবাদিক ও গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীর ১৫তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ‘ভোরের কাগজ পাঠক ফেরাম’ সিলেট পরিবারের উদ্যোগে এক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। আগামী ১৯ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় সিলেট নগরের ব্লু-ওয়াটার শপিং সিটির ৯ম তলায় (লিফটের ৮) অবস্থিত ভোরের কাগজ অফিসে এই আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে।
আলোচনাসভায় সকলকে উপস্থিত থাকার জন্য ভোরের কাগজ পাঠক ফোরাম সিলেট পরিবারের সভাপতি অমিতা বর্ধন ও সাধারণ সম্পাদক মিহির মোহন বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন।