ওমরাহ পালনে যেসব ভুল হয়
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
যেহেতু হজ-ওমরাহ এমন ইবাদত, যা সব সময় করা হয় না, তাই এর মাসআলাগুলো মানুষের কাছে পরিষ্কার থাকে না। ফলে হজ-ওমরাহ পালনে আমাদের অনেক ভুলভ্রান্তি হয়ে যায়। এখানে এমন কিছু ভুলভ্রান্তি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—
ইহরাম বাঁধার ক্ষেত্রে যে ভুল হয়
অনেকে মনে করে, ইহরামের কাপড় পরে নামাজ পড়ার পর নিয়ত করলেই ইহরাম সম্পন্ন হয়ে যায়। এই ধারণা ভুল।
বিজ্ঞাপন
বরং নিয়তের পর অবশ্যই তালবিয়া পড়তে হবে। ইহরাম সম্পন্ন হওয়ার জন্য নিয়ত ও তালবিয়া দুটিই জরুরি। (তিরমিজি : ১/১০২, গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা ৬৫, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ৮৯)
মক্কাগামীদের জন্য জিদ্দায় ইহরাম বাঁধা : কেউ কেউ আগে থেকেই ইহরাম বাঁধা ঝামেলা মনে করেন এবং ভাবেন যে ইহরাম বেঁধে নিলেই তো ইহরামের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়ে যাবে। বিমান যেহেতু জেদ্দায় অবতরণ করবে, তাই জেদ্দায় ইহরাম বাঁধার ইচ্ছায় ইহরামকে বিলম্বিত করেন। অথচ মিকাতের বাইরের হজযাত্রীদের জন্য ইহরাম ছাড়া মিকাত অতিক্রম করা জায়েজ নেই। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ১৫৭০২, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ৮৪, গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা ৬০, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২২১, আলমুগনি ইবনে কুদামা : ৫/৭৬, রদ্দুল মুহতার : ২/৪৭৭)
ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করা যাবে না মনে করা : কেউ কেউ মনে করেন, যে কাপড়ে ইহরাম বাঁধা হয়েছে, সেই কাপড় হালাল (ইহরাম শেষ) হওয়ার আগ পর্যন্ত বদলানো যাবে না। এটা একটা ভুল ধারণা। ওই কাপড় নাপাক না হলেও বদলানো যাবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ১৫০১০, ১৫০১১, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ৯৮, গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা ৭১)
তাওয়াফের সময় ছাড়াও ইজতিবা করা : অনেককে দেখা যায়, ইহরামের প্রথম থেকেই ইজতিবা (বাঁ কাঁধের ওপর চাদর রেখে ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে পরিধান করা) করে থাকেন এবং হালাল হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকাকে ইসলামের বিধান মনে করেন। এটি ভুল। এভাবে নামাজ পড়লে নামাজ মাকরুহ হবে। সব তাওয়াফেও এটি সুন্নত নয়; বরং যে তাওয়াফের পর সায়ি করতে হয়, শুধু সেই তাওয়াফেই ইজতিবা করতে হয়। অতএব, নফল তাওয়াফে ইজতিবা নেই। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২২৫, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১২৯, আলমুগনি ইবনে কুদামা : ৫/২১৭)
ইহরাম অবস্থায় সুগন্ধিযুক্ত বাইতুল্লাহ স্পর্শ করা : বাইতুল্লাহর দেয়ালে ও গিলাফে নিচ থেকে সাত-আট ফুট পরিমাণ চারদিকেই সুগন্ধি লাগানো থাকে, তাই যেকোনো অংশে হাত লাগানোর দ্বারা হাতে সুগন্ধি লেগে যায়, যা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ। (মুসলিম : ১/৩৭৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১২৪, আলমুগনি ইবনে কুদামা : ৫/১৪০, আদ্দুররুল মুখতার : ২/৪৮৭)
বাইতুল্লাহর যত্রতত্র চুম্বন, স্পর্শ ও আলিঙ্গন করা : রাসুল (সা.) ও সাহাবা-তাবেঈন থেকে কেবল সীমিত কিছু স্থান স্পর্শ করা আর কিছু ক্ষেত্রে চুমু খাওয়ার কথা বর্ণিত আছে। যেমন—হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ করা, চুমু খাওয়া হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তেমনি বাইতুল্লাহর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ রুকনে ইয়ামানিতে ডান হাত বা উভয় হাত দ্বারা স্পর্শ করা সুন্নত। কেউ কেউ চুমু খাওয়ার কথাও বলেছেন। এবং মুলতাজাম, যেটি হাজরে আসওয়াদ থেকে বাইতুল্লাহর দরজা পর্যন্ত স্থান, এখানে সিনা, গাল ও উভয় হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে দোয়া করার কথা হাদিসে বর্ণিত আছে।
কাবাঘরের দরজার চৌকাঠ ধরা এবং দোয়া করার কথাও হাদিসে আছে। এর বাইরে কোথাও স্পর্শ করার কথা নেই। (তিরমিজি : ১/১৭৪, মুসলিম : ১/৪১২, মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ১৩৯৬৪, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১৩৭, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২২৫, আলমুগনি ইবনে কুদামা : ৫/২২৭)
তাওয়াফ অবস্থার ভ্রান্তিসমূহ
তাওয়াফে নির্দিষ্ট দোয়াকে জরুরি মনে করা : অনেকে তাওয়াফের প্রতি চক্করের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট দোয়া পড়াকে জরুরি মনে করেন। তাওয়াফ অবস্থায় নির্দিষ্ট দোয়া পড়া জরুরি নয়। রুকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যে ‘রব্বানা আতিনা ফিদদুনিয়া হাসানাহ…’ এই দোয়া পড়া উত্তম। এটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এ ছাড়া পুরো তাওয়াফে কোরআন-হাদিস বা সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত যেকোনো দোয়াই পড়া যেতে পারে। তেমনিভাবে অন্য যেকোনো ভালো অর্থবোধক দোয়াও পড়া যেতে পারে। দোয়া আরবিতে করাও জরুরি নয়। নিজের ভাষায় করা যেতে পারে।
জামাতবদ্ধ হয়ে তাওয়াফ করা : অনেকে জামাতবদ্ধ হয়ে তাওয়াফ করেন এবং জামাতের মধ্যে একজন মুখস্থ বা দেখে দেখে উঁচু আওয়াজে দোয়া পড়েন আর তাঁর সঙ্গে পুরো জামাত সমস্বরে দোয়া পড়তে থাকে। এটা ঠিক নয়।
(ইলাউস সুনান : ১০/৮২, বাদায়েউস সানায়ে : ২/৩৪০, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১৩৫, রদ্দুল মুহতার : ২/৪৯৭-৪৯৮)
পুরো তাওয়াফে রমল করা : অনেককে দেখা যায়, তাওয়াফের সাত চক্করেই রমল করে থাকেন। আবার কেউ কেউ নফল তাওয়াফেও রমল করেন। মনে করেন, রমল সব তাওয়াফে এবং তাওয়াফের সব চক্করেই করতে হয়। অথচ এটি ভুল। রমল শুধু ওই তাওয়াফেই করতে হয়, যে তাওয়াফের পর সায়ি আছে। আর এই তাওয়াফেরও সব চক্করে নয়, শুধু প্রথম তিন চক্করে।
অন্যকে কষ্ট দিয়ে রমল করা : রমল করা সুন্নত। মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম। তাই প্রচণ্ড ভিড়ে অন্যকে কষ্ট দিয়ে রমল করা যাবে না; বরং তখন স্বাভাবিকভাবে চলবে। চলতে চলতে কখনো সামান্য ফাঁকা পেলে এবং অন্যের কষ্ট না হলে স্বাভাবিক গতিতে রমলের চেষ্টা করবে। (মুসলিম : ১/৪১০, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৩৪, আলমুগনি ইবনে কুদামা : ৫/২১৭, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২২৬)
নারীদের রমল : রমল শুধু পুরুষের জন্য। এ বিধানটি নারীদের জন্য নয়। কিন্তু কখনো কখনো নারীদেরও তা করতে দেখা যায়। এটি ভুল। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ১৩১১০, হিন্দিয়া : ১/১৩৫, আলমুগনি ইবনে কুদামা : ৫/২৩৬)
তাওয়াফ অবস্থায় কাবা শরিফের দিকে বুক ফেরানো : তাওয়াফকারী পুরো তাওয়াফ অবস্থা্য় বাইতুল্লাহকে বাঁ পাশে রেখে চলবেন। শুধু রুকনে ইয়ামানি ছোঁয়ার সময় (যদি ছোঁয়া সম্ভব হয়) যেহেতু উভয় হাত কিংবা ডান হাতে বাইতুল্লাহ স্পর্শ করতে হবে, তাই তখন বাইতুল্লাহর দিকে সিনা ফেরানো যাবে। কিন্তু সিনা বাইতুল্লাহর দিকে করলে ওই স্থান থেকেই আবার বাইতুল্লাহ বাঁ দিকে রেখে তাওয়াফ শুরু করতে হবে। তারপর হাজরে আসওয়াদের কাছে গিয়ে আবার সেদিকে ফিরবেন। (মুসলিম : ১/৪০০, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১৫৩, গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা ১১৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২২৫, আলমুগনি : ৫/২২৫, আদ্দুররুল মুখতার : ২/৪৯৪)
নফল তাওয়াফের পর দুই রাকাত নামাজ না পড়া বা বিলম্বে পড়া : অনেককে দেখা যায়, একের পর এক নফল তাওয়াফ করতেই থাকেন। একটি তওয়াফ শেষ হলে তাওয়াফের দুই রাকাত নামাজ পড়েন না। অথচ ফরজ ও ওয়াজিব তাওয়াফের মতো নফল তাওয়াফের পরও দুই রাকাত নামাজ পড়া ওয়াজিব এবং বিনা ওজরে একাধিক তাওয়াফের নামাজকে একত্রে পড়া মাকরুহ। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ১৩৭০৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২২৭, রদ্দুল মুহতার : ২/৪৯৯, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১৫৫, গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা ১১৭)
মাকামে ইবরাহিমকে পেছনে রেখে নামাজ পড়া : এ দুই রাকাত নামাজ মাকামে ইবরাহিমকে সামনে রেখে পড়া সুন্নত। কিন্তু অনেককে দেখা যায়, মাকামে ইবরাহিমকে পেছনে রেখে মাকামে ইবরাহিম ও বাইতুল্লাহর মাঝের ফাঁকা জায়গায় নামাজ পড়েন। এতে সেই সুন্নত আদায় হয় না। (নাসায়ি : ২/৩১, মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক : ৮৯৬০, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১৫৬, গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা ১১৬, আলমুগনি ইবনে কুদামা : ৫/২৩১, রদ্দুল মুহতার : ২/৪৯৯)
সায়ি করতে গিয়ে যেসব ভুল হয়
সায়িতে নির্দিষ্ট দোয়াকে জরুরি মনে করা। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ১৪৭১২, ১৪৭১৪, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১৮০, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২২৬, গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা ১২৯, আদ্দুররুল মুখতার : ২/৫০০)
সাত চক্করেই সাফা পাহাড়ে এসে মাসনুন দোয়াটি পড়াকে সুন্নত মনে করা। অথচ সায়ি শুরু করার সময় শুধু প্রথমবারই সাফা পাহাড়ে চড়ে এই দোয়া পড়া সুন্নত। (নাসায়ি : ২/৩৩, মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১৭১, গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা ১২৯)
সায়িতে ইজতিবা করা। (মানাসিক মোল্লা আলি কারি, পৃষ্ঠা ১২৯, গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা ১৩০, আলমুগনি ইবনে কুদামা : ৫/২১৭, রদ্দুল মুহতার : ২/৫০০)