জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি ঐতিহাসিক বক্তব্য

দৈনিকসিলেটডটকম
গত ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ (সোমবার) জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি বক্তব্য দেন। তাঁর এই বক্তব্যকে অনেকেই এসময়ের শ্রেষ্ট এবং ঐতিহাসিক বক্তব্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। দৈনিকসিলেটডটকম-এর পাঠকদের জন্য বক্তব্যটি হুবহু তোলে ধরা হলো:
মাননীয় স্পিকার, আপনাকে ধন্যবাদ। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
প্রথমেই আমি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, নিবেদিতপ্রাণ সাংসদ মতিয়া চৌধুরী সংসদের উপনেতা নির্বাচিত হওয়ায় তাঁকে শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের জন্যে আমি তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই এবং সেই সাথে এই মহান সংসদে আমি প্রথমেই শ্রদ্ধা জানাই জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বাধীন জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি শুধু একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ উপহার দিয়ে যাননি সেই সাথে জাতির পিতা হিসেবে একে শক্ত বলিষ্ঠ ভীতের উপর দাঁড় করিয়ে গেছেন। তার সরকারের মাত্র আড়াই মাসের মাথায় তিনি বন্ধু-প্রতিম বিদেশি সৈন্যদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হন। সাড়ে তিন বছরে ১৩৬ দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেন এবং সব বড় বড় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ অর্জন করেন, এমনকি জাতিসংঘের সদস্য পদ অর্জন করেন। এই সবই সম্ভব হয়েছিল তার ক্যারিশমাটিক এবং ডাইনামিক লিডারশিপের জন্যে। জাতি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।
মাননীয় স্পিকার,
স্বাধীন দেশ তৈরি করে একে শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করেই তিনি ক্লান্ত হননি, তিনি আমাদের হৃদয়ে, আমাদের প্রতিটি হৃদয়ে সোনার বাংলার স্বপ্ন গ্রোথিত করে দিয়ে গেছেন। সোনার বাংলা হবে একটি উন্নত, স্থিতিশীল, অসাম্প্রদায়িক অর্থনীতি, যেখানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সেবা সবার জন্য নিশ্চিত হবে। সুখের বিষয় যে, আমাদের রাষ্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বাংলাদেশকে আজ একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতি “আ ভাইব্র্যান্ট ইকোনমি, আ ল্যান্ড অব অপরচুনিট” হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেজন্য অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। বস্তুতঃ শেখ হাসিনা পৃথিবীতে এক নতুন দিক-দর্শন চালু করেছেন। এর মূল হচ্ছে সকলের সাথে বন্ধুত্ব রেখে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা অক্ষুন্ন রেখে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা জনগণের কল্যাণ, ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা– এই দর্শনকে আমি হাসিনানোমিক্স (Hasinanomics) বলে আখ্যায়িত করতে চাই।
মাননীয় স্পিকার,
এই হাসিনানোমিক্স- এর ফলে আজ আমরা সম্ভাবনাময় দেশ আজ আমরা “আ ল্যান্ড অব অপরচুনিট”। দেশে-বিদেশে আমাদের মান-ইজ্জত বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধন্য শেখ হাসিনা, ধন্য বাংলাদেশ। লক্ষণীয় যে, হাসিনানোমিক্স অর্জনের জন্য তিনি চালিকাশক্তি হিসেবে চালু করেছেন; (১) ডিজিটাল বাংলাদেশ, (২) ইনোভেশন বা সৃজনশক্তির বিকাশ, (৩) এন্টারপ্রেনারশিপ বা ব্যক্তি উদ্যোগ, (৪) ফ্রি মার্কেট লিবারেল এন্টারপ্রাইজের উপর জোর দিয়েছেন। যার ফলে আমাদের অর্থনীতি শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়েছে।
মাননীয় স্পিকার,
আমি যদি বিএনপি আমলের সাথে তুলনা করি, তাহলে অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বলতে পারি যে, সর্বক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের অর্জন অনেক অনেক বেশি। যেমন; (১) সন্ত্রাস, নির্যাতন, ধর্ষন, হত্যা, লুট, ‘বাংলা ভাই- আমরা হব তালেবান, বাংলাদেশ হবে আফগানিস্তান’ যা বিএনপি-জামাত সরকারের বৈশিষ্ট্য ছিল তা এখন অনুপস্থিত। (২) বিএনপি সরকারের গড় জিডিপি ছিল ৬০ বিলিয়ন ডলার, এখন তার সাড়ে সাত গুণ বেড়ে ৪৬০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে এবং বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর ৩৫তম বড় অর্থনীতির দেশ। সাবাস বাংলাদেশ, সাবাস শেখ হাসিনা। (৩) বিএনপি-জামাত সরকারের আমলে মাথাপিছু আয় ছিল গড়ে ৪৪৯ ডলার তা সোয়া ছয় গুণ বেডে এখন ২৮২০ ডলার। (৪)বিএনপি সরকারের সময়ে গড় রপ্তানি ছিল ৭.৪ বিলিয়ন ডলার, আর এখন সাতগুণ বেড় ৫২ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছে। (৫) বিএনপি সরকারের সময় শিক্ষার হার ছিল ৪৭ ভাগ, আর এখন ৭৪ ভাগ। (৬) শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৫৫ জন, আর এখন ২৫ জন। (৭) ফরেন এক্নচেন্জ রিজার্ভ ছিল গড়ে মাত্র ৩.৪ বিলিয়ন, আর এখন ১০ গুন বেড়ে ৩৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
মাননীয় স্পিকার,
বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, মেট্রোরেল, পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল যা তাদের চিন্তাধারায় অকল্পনীয় ছিল সেগুলো শেখ হাসিনা সম্ভব করেছে। জয়তু শেখ হাসিনা। দেশের অবকাঠামোতে বৈপ্লবিক অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি গরীব ও কায়িক শ্রমিকদের কথা ভুলে যান নাই। এক সময় যা আমাদের দেশে কল্পনার বাইরে ছিল যেমন- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, যারা নির্যাতিত, বিধবা, যাদের কাজ নেই, বেকার, তাদের জীবনমান উন্নয়ন করার জন্য তিনি ধনী দেশের মতো যেমন সোশ্যাল প্রটেকশন প্রোগ্রাম থাকে, যেমন- আমেরিকায় সোশ্যাল সিকিউরিটি প্রোগ্রাম আছে তা শুধু চালু করেন নাই, বাজেটের একটি বিরাট অংশ প্রায় ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা এ বাবদে বরাদ্দ করেছেন, উন্নয়নশীল দেশও যে পারে তার নজীর সৃষ্টি করেছেন। এর ফলে করোনার মধ্যেও আমাদের অর্থনীতির সচল ছিল জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৯৪% যা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ। তার এসব পলিসির ফলে স্ট্যাগফ্লেশন আমাদের দেশে অনুপস্থিত।
মাননীয় স্পিকার,
আমাদের এতো উন্নয়ন দেখে দেশবিরোধী, সরকার বিরোধী কিছু স্বার্থান্বেষী লোক মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচারণায় উঠে পড়ে লেগেছে। তারা গুজব ছড়িয়ে সরকারের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়। তারা বলে, “বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার মত অর্থনৈতিক সমস্যা পড়বে, তারা বলে বেড়ায় ব্যাংকে টাকা নাই, আপনার টাকা তুলে নেন, দেশের রিজার্ভ নেই, দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।” দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, গুজবে কান দিবেন না। আমাদের অর্থনীতির সব সূচক স্থিতিশীল ও বলিষ্ঠ। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ, যারা এগুলো দেখভাল করে, তারা বলেছেন, “এইসব আশঙ্কা অমূলক ও ভিত্তিহীন।”
মাননীয় স্পিকার,
কোন কোন ব্যক্তিবিশেষ বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগের ইতিহাস জানেন না বলে মাঝে-মধ্যে অবান্তর আশঙ্কা তুলে ধরেন। তাদের অবগতির জন্য জানাতে চাই যে, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন অর্থাৎ To uphold democracy, human rights, justice, and dignity to human being. এ জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছি। এ জন্যই বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়েছে। বিশ্বে এমন নজির কোথাও পাবেন না। এবং এজন্যই বাংলাদেশ সৃষ্টির পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকার দশ মাসের মাথায় শাসনতন্ত্র প্রদান করেন যেখানে ডেমোক্র্যাসি, জাস্টিস, হিউম্যান রাইটস অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে উল্লেখিত আছে। ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্যে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সবসময় সংগ্রাম করেছে। স্বচ্ছ্ব ও সুন্দর নির্বাচন যাতে হয় তার জন্যে আওয়ামী লীগ সরকার ফটো আইডি তৈরি করেছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স উপহার দিয়েছে এবং বিশেষ করে সম্পূর্ণ স্বাধীন ইলেকশন কমিশন তৈরি করেছে। এখন আর বিএনপি আমলের এক কোটি ২৩ লক্ষ ভুয়া ভোটের যুগ চলে গেছে। ১০টা হোন্ডা, ২০টা গুন্ডার দিন চলে গেছে। আর আজিজ মার্কা ইলেকশন কমিশনও নেই। এজন্যই বোধ হয়, তাদের অন্তরে এতো জ্বালা। আওয়ামী লীগ স্বচ্ছ্ব নির্বাচনে বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগের শক্তি হচ্ছে জনগণ। আওয়ামী লীগের স্লোগান হচ্ছে, আমার ভোট আমি দিব, যাকে ইচ্ছা তাকে দিব। সুতরাং আপনাদের এ নিয়ে দুঃচিন্তার প্রয়োজন নেই।
মাননীয় স্পিকার,
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রোডম্যাপ ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশ। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, (১) ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি, (২) পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি, এবং (৩) রিজিওনাল পিস এন্ড স্ট্যাবিলিটি এসব প্যাকেজ পলিসি চালু করেছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য, জনশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য, অধিকতর বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বাণিজ্য বৃদ্ধি, গেইনফুল এমপ্লয়মেন্ট, টেকনোলজি ট্রান্সফার ও উৎকর্ষ সেবা দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়া মূল লক্ষ্য। আমাদের ৮১টি মিশন এগুলো অর্জনের জন্য কাজ যাচ্ছে। জেনে খুশি হবেন যে, কোভিডের সময়ও এফডিআই প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে যা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। আমাদের বাণিজ্য বেড়েছে এবং নতুন নতুন দেশে যেমন সম্প্রতি রোমানিয়ার মতো দেশে আমরা প্রায় ১২০০০ লোক পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। মালদ্বীপ, গ্রীস এবং বাহরাইনে অবস্থান করা অবৈধ শ্রমিকদের বৈধতা দেয়া শুরু হয়েছে।
মাননীয় স্পিকার,
আমার সিলেট এলাকায় অনেকগুলো কাজ চলমান আছে এবং সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তবে সেই ব্রিটিশ যুগের আখাউড়া থেকে সিলেট মিটারগেজ রেলওয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয়। চলচল বন্ধ হয়ে যায়। মাননীয় রেলমন্ত্রী বলেছেন যে, এই প্রজেক্টটি সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং টাকাও সংগ্রহ করা হয়েছে। সুতরাং এর অনুমোদন দিলে বৃহত্তর সিলেটবাসী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার জন্য দোয়া করবে এবং মানুষের হয়রানিও কমবে। অর্থনৈতিকভাবে সুফল আসবে।
মাননীয় স্পিকার,
বিগত ১৪ বছরে বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। সকল শ্রেণী-পেশার লোক তাতে উপকৃত হয়েছে। সেশনজট নেই, হরতাল, ধর্মঘট, আন্দোলন নেই, সন্ত্রাস নেই, ছেলে মেয়েরা নিশ্চিন্তে বাড়ি যেতে পারে। ব্যবসায়ীরা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করছেন। গরিবদের হাতে টাকা এসেছে। খাদ্য আছে, মানুষের আয় বেড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অর্জন এখন বিশ্বের বিস্ময়। জাতিসংঘের মতে, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। তবে এতে কিছু সংখ্যক গোষ্ঠী বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্ন করার জন্য চেষ্টা করছেন। তাদের থেকে সাবধান!
মাননীয় স্পিকার,
যে সমস্ত রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা আছে যেমন; সিঙ্গাপুর, রুয়ান্ডা, আরব আমিরাত, এ সমস্ত দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা করেছে। অন্যদিকে যে সমস্ত দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থিতিশীলতা নাই যেমন; ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া এবং বর্তমানে ইউক্রেন তাদের জীবন-মান ও অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সুতরাং দেশের মঙ্গলের জন্য, জনগণের মঙ্গলের জন্য আমাদের অবশ্যই স্থিতিশীলতা ও শান্তি বজায় রাখতে হবে। শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য যা যা করার প্রয়োজন ইনশাল্লাহ আমরা তা করে যাবো। আমরা বিজয়ী জাতি, আমরা অবশ্যই জয়লাভ করবো।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু,
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।