সোর্সকে সাজালেন বিশেষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা

দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
দুই সোর্সকে বিশেষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে পুলিশ প্রটোকল দিয়েছেন সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন চন্দ্র মোদক।
শুধু তাই নয়, পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে তারা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িসহ ৭টি বাড়িতে মাদক উদ্ধারের নামে অভিযান চালান। এ সময় অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ কয়েকজনকে হেনস্তা করেছেন বলে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গ্রামবাসী ভুয়া দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গুদিগাঁও গ্রামে।
জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ সদর থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন স্যার একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয়ে রহস্যজনক দুই ব্যক্তিকে পুলিশি প্রটোকল দেওয়ার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশেই ভুয়া দুই ব্যক্তিকে সহযোগিতার জন্য পুলিশ ফোর্স দেওয়া হয়। আবার গ্রামবাসী যখন তাদের ধাওয়া দিয়ে সুরমা নদীতে ফেলে আটক করেন, তখন সেই স্যারের নির্দেশেই তাদের আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। পুরো বিষয়টিই বুঝলাম না, ওরা কারা?’
এদিকে রহস্যজনক কারণে এতবড় ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়। একপর্যায়ে খবর পেয়ে ঘটনার ৩ দিন পর একটি তদন্ত কমিটি করেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ। তবে এই তদন্ত কমিটি নিয়েও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
কারণ বিসিএস ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তা রিপন চন্দ্র মোদকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তদন্ত করছেন ৩৩ ব্যাচের জুনিয়র কর্মকর্তা। যিনি সুনামগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম খান। অথচ নিয়মানুযায়ী কখনও জুনিয়র কর্মকর্তা সিনিয়র কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত করতে পারেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ শনিবার বলেন, ‘তিনি ঘটনাটি জেনেছেন ২৭ জানুয়ারি। খোঁজখবর নিয়ে ২৯ জানুয়ারি অনুসন্ধানপূর্বক তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী যিনি দায়ী থাকবেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২৫ জানুয়ারি রাত আনুমানিক ১০টার দিকে দুজন ব্যক্তিকে নিজের সরকারি গাড়িতে শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে নিয়ে আসেন সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদক। জেলা গোয়েন্দা শাখার ইন্সপেক্টর নন্দন কান্তি ধরকে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনার জন্য ট্রাফিক পয়েন্টে ফোর্স পাঠাতে বলেন।
নির্দেশ অনুযায়ী এসআই মাসুদ আলম ভূঁইয়া, এএসআই দেলোয়ার হোসেন ও কনস্টেবল আরিফিন চৌধুরীকে সেখানে পাঠানো হয়। যারা ২১৫ নম্বর জিডি মূলে থানা থেকে বের হন। জিডিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নির্দেশে অভিযানে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে। অভিযানের নামে দলটি শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে হাজির হলে রিপন কুমার মোদক তাদের জানান, এই দুজন একটি বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর মেজর পর্যায়ের কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে একজন মেজর নাহিদ, অন্যজনকে বিজন নামে পরিচয় করিয়েও দেন।
বলা হয়, এই দুই কর্মকর্তা একটি অভিযানে যাবেন এবং তাদের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করতে তিনি পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নির্দেশ মোতাবেক পাঁচ সদস্যের পুলিশ টিম বাইরে থেকে মোটরসাইকেলে আসা দুই কর্মকর্তাকে প্রটোকল দেওয়া শুরু করেন। এরপর দুই কর্মকর্তা পুলিশের টিম নিয়ে ইব্রাহিমপুর খেয়া পার হয়ে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের নারায়ণতলা কোনাপাড়া গ্রামে যান।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রথমেই বিশেষ বাহিনীর দুই কর্মকর্তা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুকসেদ আলীর বাড়িতে প্রবেশ করেন।
এরপর তারা ঘরের দরজায় বেশ কয়েকবার সজোরে ধাক্কা দেন। ভেতর থেকে পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের বিশেষ একটি গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। পরিচয় শুনে দরজা খুলে দিলে ভেতরে ঢুকে পুরো ঘর তল্লাশি করতে থাকেন। এ সময় তারা (কথিত দুজন মেজর নাহিদ ও বিজন) বাড়ির অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূর ঘরে ঢুকে তাকেও নাজেহাল করেন।
মুকসেদ আলীর ছেলে পিয়ার আহমেদ জানান, ঘটনার সময় পুলিশের তিন সদস্য বাড়ির বাইরে অবস্থান করছিলেন। একপর্যায়ে তারা মুকসেদ আলীর বাড়ির পার্শ্ববর্তী জয়নাল আবেদিন, প্রতিবন্ধী দুলাল মিয়া, প্রতিবন্ধী হারুন মিয়া, সেলিম মিয়া, আব্দুল খালেক ও আমির হোসেনের বাড়িতেও তল্লাশি চালান। কিন্তু কোথাও কিছু না পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় গ্রামের লোকজন তিন পুলিশসহ কথিত দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে ঘেরাও করে ফেলেন।
তাদের পরিচয় জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে না পারায় তাদের ওপর চড়াও হন গ্রামবাসী। একপর্যায়ে তাদের সুরমা নদীতে ফেলে দেন গ্রামবাসী। স্থানীয়রা সদর থানা পুলিশকেও বিষয়টি অবহিত করেন। ঘটনার একটি ভিডিও চিত্র হাতে সংরক্ষিত আছে।
ঘটনাটি বড় হওয়ায় তাৎক্ষণিক খবর পেয়ে যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদক। তিনি সদর থানা পুলিশকে ফোর্স পাঠানোর নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুযায়ী সদর থানা থেকে এসআই রফিকুল ইসলাম, কনস্টেবল নিলয় সূত্রধর ও উজ্জ্বল চৌধুরী ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের হাত থেকে কথিত দুই মেজর ও ডিবি পুলিশের ৩ সদস্যকে উদ্ধার করে নৌকায় সুনামগঞ্জ সদরে নিয়ে আসেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সদর থানা পুলিশ কথিত দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদক তাদের ট্রাফিক পয়েন্টেই ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এমনকি তাদের নাম-ঠিকানা পর্যন্ত যাতে তারা জানতে না চান সেই নির্দেশও দেন। এ ঘটনার পর বিষয়টি গোপন রাখা হয়।
এদিকে ঘটনার ৩ দিন পর বিষয়টি তদন্তের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তদন্ত করতে দাপ্তরিক পত্র দেওয়া হয় ৩৩ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম খানকে।
তদন্তের নির্দেশনা পত্রে (স্মারক নং-১২৯/সি, তারিখ : ২৯/০১/২০২৩) একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, ‘মেজর পরিচয়ে দুজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুকসেদ আহমেদের বাড়িতে অভিযান চালানোর সময় স্থানীয় লোকজন তাদের আটক করে। পরে ডিবি পুলিশের একটি দল পাশাপাশি থাকায় তাদের উদ্ধার করে। পরে সদর থানার একটি দল ঘটনাস্থল থেকে তাদের শহরে নিয়ে আসে।’
বিষয়টি অনুসন্ধান করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে তদন্তের চিঠিতে বিষয়টির সঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদকের সম্পৃক্ত থাকা এবং পুলিশ প্রটোকল দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, ‘অনুসন্ধান চলমান রয়েছে, শিগগিরই প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বিষয়টি শুনেই কথা বলতে চাননি। ব্যস্ততা দেখিয়ে বলেন, ‘এ বিষয়ে তিনি পরে কথা বলবেন।’
এদিকে কথিত দুই মেজর সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, এরা মূলত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদকের সোর্স। ঘটনার দিন রাতেও সরকারি গাড়িতে এই দুজনকে নিয়ে পুলিশ লাইনে যান রিপন কুমার মোদক। সেখানে তাদের সঙ্গে তিনি ব্যাডমিন্টনও খেলেন। এর আগে সদর থানা কমপ্লেক্সেও এই দুজনকে নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলেন।
সুত্র: যুগান্তর