সিলেটে কৃষি বিপ্লব ঘটালেন জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান

মুহিত চৌধুরী
মো: মজিবর রহমান সিলেটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি সিলেটে যোগদান করেন। কিছুটা মৃদুভাষী হবার কারণে প্রথমে তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরণের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিলো । তিনি কেমন হবেন? সিলেটের মানুষের জন্য কতটুকু অবদান রাখতে পারবেন?
অল্প দিন যেতে না যেতেই তিনি স্বমহিমায় আর্ভিভূত হলেন। মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেন একজন কর্মঠ এবং দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে। তিনি কথা কম বলে কাজ বেশি করতে ভালোবাসেন।
সিলেট আসার কয়েক মাস পর সিলেটের ইতিহাসে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। লাখ মানুষের বাঁচার আকুতিতে সিলেটের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিলো। জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান শুরু করেন মানবিক অভিযান। প্রতিদিন তাঁর টিমকে নিয়ে ছুটে যান বন্যাদুর্গতদের মাঝে। বিতরণ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ত্রান সামগ্রী।
শুধু বন্যায় নয় হাড়কাঁপা শীতেও মানুষ তাকে কাছে পেয়েছে। গভীর রাতে তিনি শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দু’হাতে বিতরণ করেছেন শীতবস্ত্র।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে সিলেটের মানুষকে বাঁচাতে তিনি বার বার প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। পেট্রল পাম্প কিংবা পরিবহন ধর্মঘটের ঘোষণা এলে তিনি আগে নেতৃবৃন্দকে ডেকে এনে সমস্যা সমাধান করেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: মজিবর রহমান যে কারণে সারা দেশে আলোচিত সেটি হলো সিলেটে তিনি একটি অসাধ্যকে জয় করেছেন। সিলেটের অনাবাদি জমিকে চাষাবাদের আওতায় এনে রীতিমত কৃষি বিপ্লব ঘটালেন।
সিলেট বিভাগে মোট আবাদযোগ্য জমি রয়েছে ১২ লাখ সাড়ে ২৪ হাজার হেক্টর। এরমধ্যে ৪ লাখ ৬১ হাজার হেক্টরের বেশি জমি প্রতিবছর অনাবাদী পড়ে থাকে।
বৈশ্বিক সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর করে তুলতে খাদ্য উৎপাদনে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়ে “এক ইঞ্চি জমিও আনাবাদি রাখা যাবে না” মর্মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা প্রদান করেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক মো: মজিবর রহমান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় সিলেট জেলায় পতিত জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
কৃষক ও জমির মালিকদের উদ্বুদ্ধকরণের লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে সিলেট জেলার প্রতিটি উপজেলায় কৃষক সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে প্রান্তিক চাষীদের মতামত গ্রহণ করে তাৎক্ষণিক সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয় ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় সম্পর্কে কৃষকদের দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ প্রদান এবং বীজ, সার ও কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হয়। সমাবেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা কৃষি অফিসার, কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, কৃষি উদ্যোক্তা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন।
জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত কৃষক সমাবেশ প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। কৃষক ও পতিত জমির মালিকগণ অনাবাদি জমি চাষের আওতায় এনে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের ফলে রোপা আমন চাষের ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি প্রতিফলিত হয়। জেলায় বিগত মৌসুমের চেয়ে ৩,০০০ হেক্টর অধিক জমিতে রোপা আমন আবাদ করায় ৮৫০০ মে. টন চাল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫১ কোটি টাকা।
রবি মৌসুমের শুরুতে জেলার ৪১৭৯৮ হেক্টর অনাবাদি চাষযোগ্য জমির মধ্যে ১১৫০০ হেক্টর জমি আবাদের আওতায় আনা হয়। তন্মধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
সেলক্ষ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে মোট ১৭ লক্ষ টাকার সরিষার বীজ ক্রয় করে ১৩ টি উপজেলার ৫৩৯১ জন পতিত জমির মালিক/চাষীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এছাড়া কৃষি প্রণোদনা হিসেবে জেলার ২১,৭০০ জন কৃষকের মধ্যে ২১,৭০০ কেজি সরিষা বীজ এবং সার ও কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে, সিলেট জেলায় এ বছর প্রায় ২৫০০ মে. টন সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৭ কোটি টাকা।
সিলেট জেলার কৃষক ও কৃষাণীদের কৃষি ঋণ সম্পর্কে অবহিতকরণ, সহজে কৃষি ঋণ প্রাপ্তি, তাৎক্ষণিক ঋণ প্রদান ও ঋণ বিতরণের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে জেলার সকল কৃষি ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকদের নিয়ে জেলায় প্রথমবারের সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের সম্মুখে কৃষি ঋণ মেলা ২০২৩ আয়োজন করা হয়। মেলায় ৫১৭ জন ঋণের আবেদন করেন এবং ১০৩ জন আবেদনকারীর মধ্যে এক কোটি পয়ত্রিশ লক্ষ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়।
জেলা প্রশাসক সিলেট, জেলার বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষার্থীদের মাঝে ১৫০০ প্যাকেট বিভিন্ন জাতের সবজি বীজ বিতরণ করেন ও ছাত্রছাত্রীদের কৃষিকাজে উৎসাহী করেন।
তাঁর অফিসের আঙ্গিনায় তিনি ফুলের বাগান করেছেন। যেখানে অসংখ্য মানুষ
দাঁড়িয়ে মনোতৃপ্তি লাভ করে।
মো: মজিবর রহমান সরকারি এমএম আলী কলেজ, কাগমারী, টাঙ্গাইল হতে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে বিএসসি (অনার্স) ও এমএসসি (মাস্টার্স) ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি কর্মজীবনে এসে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ইউনিভার্সিটি অব গ্রিনিচ লন্ডন, ইউকে হতে ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান প্রমাণ করেছেন সততা, দেশপ্রেম দায়িত্ববোধ, কর্মনিষ্ঠা এবং কাজকরার মানসিকতা থাকলে কোন কাজই দুঃসাধ্য নয়। মজিবর রহমানের মতো মানুষেরা প্রশাসনে আছে একথা ভাবতে গর্বে আমাদের বুক ভরে ওঠে। তাই নি:সংকোচে বলতে পারি আমরা পারবো,অবশ্যই পারবো বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে।