লৌহশিল্পের বিকাশে দাউদ (আ.)
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
বর্তমান যুগে প্রযুক্তির সাহায্যে লোহাকে গলিয়ে যেকোনো অবয়ব দেওয়া যায়। ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্পকর্মও করা সম্ভব লোহা দিয়ে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র থেকে শুরু করে সব কিছুতেই ব্যবহার করা হচ্ছে লোহা। কোথাও কোথাও লক্ষ করা যাচ্ছে লোহার ওপর সুনিপুণ কারুকার্য। বর্তমান যুগে ধাতু দিয়ে তৈরি এমন গ্লাভসও পাওয়া যায়, যা হাতে পরলে কাজ করতে কোনো ধরনের সমস্যা হয় না, আবার ধারালো ছুরি দিয়ে হাতে আঘাত করলেও হাতের কিছুই হয় না। এভাবে লোহা মানুষের প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সঙ্গী হয়ে আছে।
লোহার উৎস : বিজ্ঞান ও কোরআনের ভাষ্য মতে, লোহার উৎপত্তি এই গ্রহ থেকে নয়। লোহার আরবি হলো, ‘হাদিদ’। পবিত্র কোরআনে ‘হাদিদ’ নামে একটি সুরা আছে। সেই সুরায় মহান আল্লাহ লোহার রহস্য উন্মোচন করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আরো নাজিল করেছি লোহা, তাতে প্রচণ্ড শক্তি ও মানুষের জন্য বহু কল্যাণ আছে।’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ২৫)
উল্লিখিত আয়াতে মহান আল্লাহ লোহার দুটি রহস্য উন্মোচন করেছেন। এক. উল্লিখিত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি আরো নাজিল (অবতীর্ণ) করেছি লোহা’ অর্থাৎ পৃথিবীর বাইরে থেকে নাজিল করেছি। সুতরাং এর উৎস মহাজাগতিক। পৃথিবীতে লোহার ব্যবহার শুরু হয় বহুকাল আগে। তবে আগেকার যুগে লোহা দিয়ে যা ইচ্ছা তা বানানোর উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। নিমেষে লোহাকে লেজার ফাইবার কাট মেশিনের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে কেটে শিল্পকর্মে পরিণত করা যেত না। কিন্তু আজ থেকে তিন হাজার বছর আগেই মহান আল্লাহ তাঁর এক প্রিয় বান্দাকে কোনো রকম যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া খালি হাতেই লোহাকে গলিয়ে ফেলার শক্তি দিয়েছিলেন। যেকোনো লোহাকে খুব সহজে নিখুঁত কারুকাজের মাধ্যমে সাজিয়ে তোলার দক্ষতা দিয়েছিলেন। দক্ষতা দিয়েছিলেন সে যুগের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রতিরক্ষা উপকরণ বানানোর। নিম্নে সেই নবীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো—
কোরআনে দাউদ (আ.)-এর বর্ণনা : মহান আল্লাহর অন্যতম প্রিয় বান্দা নবী দাউদ (আ.)। নবীদের কাহিনি নামক একটি গ্রন্থ মাআরেফুল কোরআনের সূত্রে লেখা হয়েছে যে তাঁর আগমন শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী (সা.)-এর দেড় হাজার বছর আগে হয়েছিল। মহান আল্লাহ তাঁকে বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়েছিলেন। যুবক বয়স থেকেই তিনি ছিলেন প্রখর মেধাবী ও বীর। খুব অল্প বয়সেই তিনি তালুতের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধে কুখ্যাত যুদ্ধবাজ জালুতকে হত্যা করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ সে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তারা আল্লাহর আদেশে তাদের পরাজিত করল এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাউদকে দান করলেন রাজ্য ও দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দান করলেন, যা তিনি চাইলেন। বস্তুত আল্লাহ যদি এভাবে একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্তই দয়াশীল।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫১)
যুদ্ধে বীরত্বের প্রমাণ দেওয়ার পর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান। সেখানেও তিনি দক্ষতা ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রাখেন। তার প্রজ্ঞার সুনাম করে মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘আমরা তার সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাগ্মিতা।’ (সোয়াদ, আয়াত : ২০)
দাউদ (আ.)-এর রাজত্ব ও মুজিজা : তাঁদের রাজত্ব ছিল বর্তমান ফিলিস্তিনসহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায়। পৃথিবীর অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ছিলেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাঁর কৃতজ্ঞতার সুনামও করেছেন। তাঁর মুজিজাগুলো ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পর্বতমালা ও পাখিদের তাঁর অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল। কঠিন লোহা তাঁর হাতে মোমের মতো গলে যেত, তিনি তাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে অলংকরণ করতে পারতেন। তিনি তাঁর এই মুজিজার মধ্যে তৎকালীন যুগের অত্যাধুনিক বর্ম ইত্যাদি বানাতে পারতেন। পবিত্র কোরআনে তাঁর সেই শৈল্পিক দক্ষতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর অবশ্যই আমি আমার পক্ষ থেকে দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম। (আমি আদেশ করলাম) ‘হে পর্বতমালা, তোমরা তার সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা করো’ এবং পাখিদেরও (এ আদেশ দিয়েছিলাম)। আর আমি তার জন্য লোহাকেও নরম করে দিয়েছিলাম, যাতে তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করতে পারো, কড়াসমূহ সঠিকভাবে সংযুক্ত করো আর তোমরা সৎকর্ম করো। তোমরা যা করো আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী।’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ১০-১১)
উল্লেখ্য, তিনি তাঁর এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েই উপার্জন করতেন। এবং নিজের উপার্জনের টাকায় জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিজের ভরণপোষণের জন্য কিছুই নিতেন না। যদিও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের বিনিময় নেওয়া অবৈধ নয়। নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরামের কাছে তাঁর এই গুণের সুনাম করেছেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, মিকদাম (রা.) সূত্রে নবী (সা.) বলেন, নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। (বুখারি, হাদিস : ২০৭২)