সিলেটে এক যুগের ব্যবধানে ১১০ প্রতিষ্ঠানের ৯০টিই বন্ধ

দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
সিলেটে আবাসনসংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আবাসন কোম্পানিগুলো বৈশ্বিক মন্দা আর ক্রেতা সংকটে ভুগছে। দেশে নির্মাণসামগ্রীর চড়া দাম ও প্রবসী বিনিয়োগ তুলে নেয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সিলেট অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট গ্রুপ (সারেগ) সূত্র জানিয়েছে, একে একে এ সংগঠন থেকে আবাসন কোম্পানিগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে। ১২ বছরের ব্যবধানে সংগঠনের সদস্য ১১০টি কোম্পানির ৯০টি বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০-এ।
আবাসনসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসীদের তৃতীয় প্রজন্ম দেশের প্রতি আগ্রহী না হওয়া এবং ইংল্যান্ডসহ ইউরোপ প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়া সিলেটে এ শিল্পের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরাও ঋণে জর্জরিত। অথচ সিলেটের আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ ছিল এ অঞ্চলের রেকর্ড।
প্রবাসীদের ওপর নির্ভর করে চলতি শতাব্দীর শুরুর দিকে গড়ে ওঠে শতাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠান। সিলেট নগরীর আশপাশ এলাকা দিয়ে ঘুরলেই চোখে পড়ত বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানির বড় বড় বিলবোর্ড। এর মধ্যে অনেকগুলো আবাসন প্রকল্পের উদ্যোক্তা ছিলেন প্রবাসীরা। বৈশ্বিক মন্দা এসে ধাক্কা দিলে প্রবাসীরা এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তুলে নেন বিনিয়োগ। নতুন করে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ও বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে করোনায় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে এ শিল্পকে। বাধ্য হয়ে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।
সারেগ সূত্র জানায়, ২০১০ সালে এ সংগঠনের সদস্য ছিল ১১০টি কোম্পানি। ১২ বছরের ব্যবধানে এখন সেটি কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ২০টিতে। পাশাপাশি বিনিয়োগ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। নতুন করে এ খাতে আর বিনিয়োগের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১১ সালে সিলেটে প্রথম আবাসন মেলা করে সারেগ। তখন এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৭১। এরপর ২০১৩ সালের আবাসন মেলা চলকালে সদস্য ছিল ৫৮টি। সর্বশেষ ২০২৩ সালের আবাসন মেলায় তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০টি প্রতিষ্ঠানে। দীর্ঘ এ পরিক্রমায় কেউ কেউ হুজুগে মনোভাব নিয়ে আবাসন ব্যবসায় নেমে সুবিধা করতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে নেন। আবার কেউ কেউ কোম্পানির পরিচালকদের মধ্যে জমি ভাগবাঁটোয়ারা করে নেন।
সিলেট শহরতলির কুশিঘাট এলাকায় একসময় গড়ে তোলা হয়েছিল শ্যামল ছায়া হাউজিং প্রাইভেট লিমিটেড। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল ইসলাম জানান, পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে সমন্বয় করে কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। একটা সময় ব্যবসা চাঙ্গা ছিল, পরে পরিস্থিতি বিরূপ হলে কোম্পানি এ সিদ্ধান্ত নেয়।
অন্যদিকে গাজী বুরহান উদ্দিন (রহ.) মডেল টাউন নামে একটি আবাসিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের প্লট বুঝিয়ে দিতে না পারা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি এখন আর দায়িত্বে নেই, বিষয়টি দেখাশোনা করছেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রহমান।’ তবে আব্দুর রহমানের সেলফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সিলেটে সবচেয়ে বৃহৎ দুটি আবাসন কোম্পানি রয়েল সিটি ও সোনারগাঁ আবাসিক প্রকল্প। বিশাল বিনিয়োগ থাকলেও এ দুটি প্রকল্প এখনো দাঁড়াতেই পারেনি। সিলেট নগীরর দক্ষিণ সুরমা এলাকায় ‘রয়েল সিটি’ আবাসন প্রকল্পের অবস্থান। অন্যদিকে ছোটবড় বেশকিছু হাউজিং কোম্পানি গড়ে ওঠে শহরতলিতে। যেগুলোয় প্লট বিক্রি দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ। এজন্য অনেকে হুজুগে উদ্যোক্তাদের দায়ী করছেন।
সিলেট শহরতলির টুকেরবাজার ইউনিয়নের চাতলীবন্দ কৃষিজমিতে একসময় সাঁটানো ছিল সানরাইজ হাউজিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। কিছুদিন পর সেই সাইনবোর্ড আর চোখে পড়েনি। ওই প্রকল্পের কেয়ারটেকার জানান, ৭-৮ শতাংশ প্লটের ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। লন্ডনে কিছু প্লট বিক্রি হয়েছে। তবে বাস্তবে সেগুলো ধানি জমি। উদ্যোক্তারা মধ্যপথে এসে থেমে যান।
এর পাশে আরেকটি হাউজিং প্রকল্পের মাটি ভরাট হলেও কেউ বাসাবাড়ি করতে আসছেন না। লন্ডনে পাঁচ-সাতটি প্লট বিক্রি হয়েছে মাত্র। এভাবে আশপাশ এলাকায় অনেক হাউজিং প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও কার্যত অচল হয়ে আছে।
ড্রিমসিটি নামের আরেকটি কোম্পানি বিপুল পরিমাণ ভূমি কিনলেও সেটি হাউজিংয়ে রূপ দিতে পারেনি। উদ্যোক্তা জুনেদ আহমদ বলেন, ‘বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এ শিল্পকে বেশি দূর এগোতে দেয়নি।’
সারেগের সাবেক সভাপতি হাসিন আহমদ মনে করেন, কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হলেও সিলেটে আবাসন ব্যবসা পরিকল্পনাহীনভাবে অনকেটা হুজুগে গড়ে উঠেছে। যে যেখানে পারছে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এছাড়া অনেকেই আবাসনের নামে ঋণ এনে অন্য খাতে টাকা ব্যয় করেছে। সেখানে লাভবান হতে না পেরে ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এসব কারণেও ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়।
সবচেয়ে বৃহৎ হাউজিং কোম্পানি সিলেট রয়েল সিটির চেয়ারম্যান ফয়সল আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটের যারা বিনিয়োগকারী ছিলেন তাদের অনেকেই সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আবাসন ব্যবসায় স্থবিরতা নেমে আসায় যে কেবল বিনিয়োগকারীরাই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তা নয়, বরং সিলেট অঞ্চলে কর্মসংস্থানেও স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর বাইরে বিশ্বমন্দা ও করোনা পুরো আবাসন খাতকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের প্লট বিক্রি বন্ধ। পুরনো কিস্তিও নিয়মিত আদায় হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে আমাদের।’
সারেগের সাধারণ সম্পাদক দেলওয়ার হোসেন বলেন, ‘হাজার কোটি টাকার বেশি এ খাতে বিনিয়োগ। আগে আমরা বিনিয়োগের একটা উদ্যোগ নিলে ৬০-৭০ শতাংশ প্রবাসী বিনিয়োগকারী থাকতেন। এখন সেটা ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। সবাই ভালো করতে পারেননি। এজন্য এখন আর এ ব্যবসায় কেউ আসতে চান না। সিলেটে মেলা আয়োজন হয়েছিল, এতে খুব একটা সাড়া পাওয়া না গেলেও আশার সঞ্চার হচ্ছে। অনেকেই সদস্য নবায়ন করেননি। কারণ ব্যবসা যখন নেই, তখন নবায়নের আগ্রহ দেখাননি। এজন্য সদস্যপদ নবায়ন করেননি।
সুত্র: বণিক বার্তা