আধুনিক নার্সিংয়ে অধ্যাপক ড.নীলিমা মজিদ
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
বর্তমান ধুনিক নার্সিংয়ে দেশে যে ক’জন মনিষীর কথা মনে পড়ে তন্মধ্যে অামাদের প্রিন্সিপাল ড.নীলিমা মজিদ ম্যাডামও একজন। ম্যাডামের সরাসরি ছাত্রী হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। নার্সিং সমাজে ড.নীলিমা মজিদ ম্যাম যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন সকলের মণি কোঠায়। স্থান করে নিবেন এক অালোকবর্তিকা হিসেবে। একজন অাদর্শ পথপ্রদর্শক হিসেবে৷ সদ্য অবসরকালীন ড.নীলিমা মজিদ ম্যাম অামাদের কোর্সের একেবারে তীরে এসে বিদায় নিলেন অামাদের কাছ থেকে। যা অামার/অামাদের জন্য এক বেদনাদায়ক মুহুর্ত। অারো ক’টা দিন থাকলে বলতে পারতাম কোর্সের শুরু থেকে শেষ অবধি নীলিমা ম্যামের ছাত্রী ছিলাম। কোর্স চলাকালীন সময়ে প্রিন্সিপাল ম্যাম প্রশাসনিক দায়িত্বের পাশাপাশি অামাদের পাঠদানেও প্রচুর সময় দিতেন। সকল ব্যাচেই ফাইলপত্র হাতে নিয়ে তিনি পাঠদানে মগ্ন থাকতেন সময়ের পর সময়। ম্যাডামের পড়ানোর ধরণটাই ছিলো সম্পূর্ণ অালাদা। বিশেষ করে মেডিকেল সার্জিক্যাল সাবজেক্ট যখন পড়াতেন তখন একেকটা ডিজিজ’র উপর এতো এতো লেকচার দিতেন যেনো কোন রোগীকে সামনে রেখে কথা বলছেন। ডিজিজ’র সাইন সিম্টম, ইটিওলজি, ডায়াগনোসিস সহ এভরিথিং সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন অার অামরা মনোমুগ্ধকরভাবে মেমোরাইজ করতাম। স্পষ্ট কথাবলা অার বচনবঙ্গিমা অামাদেরকে মুগ্ধ করতো যেনো মুখ দিয়ে মুক্তাঝরার মতো। সময়ের ব্যাপারে ম্যাডাম ছিলেন একজন অাইডল। তিনি সময়কে গুরুত্ব সহকারে দেখতেন এবং খুবই বেশি মূল্যায়ন করতেন।বার্ধ্যক্যের বয়সে এসেও সময়ের প্রতি উনার এতো মূল্যায়ন অামাদেরকে ভাবিয়ে তুলে। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উনার সহকর্মীরা ম্যাডামের সময়ের প্রতি যত্নবান হওয়ার কথা প্রায় সময় উল্লেখ করতেন। অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে টিম ওয়ার্ক করে করে কাজ করতেন বলে উনার সহকর্মীরা অনুষ্ঠানে অালোচনা করতেন এবং অামাদেরকে নীলিমা মজিদ ম্যাডামের পদাংক অনুসরণ করার কথা বলতেন। এতো এতো দায়িত্বের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে উনার সময়দান অামাদের মনে অনুপ্রেরণা যোগায়। ন্যায়বিচার অার ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবীতে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন৷ সকল ছাত্রছাত্রীই তাঁর কাছে ছিলো এক ও অভিন্ন। সকলকেই তিনি সমান চোখে দেখতেন, ন্যায়ের প্রতি ছিলেন অটল। প্রশাসনিক দায়িত্বশীলতায় অামাদের কলেজে বিভিন্ন কোর্স, সিট বৃদ্ধি সহ অারো অনেক সুযোগ সুবিধা ম্যাডামের হাত ধরে সূচনা হয়েছিলো।এক কথায় উইমেন্স নার্সিং কলেজ, সিলেট’ ড. নীলিমা মজিদ ম্যাম ছাড়া কল্পনা করা যায় না। ড.নীলমা মজিদ ম্যাডামকে বর্তমান নার্সিংয়ের এক যুগ পথিকৃৎ বলা যায়।
ড.নীলিমা মজিদ ১৯৫৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে নোয়াখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে SSC (2nd Division)পাশ করেন। মহান এই মনীষী ১৯৭৮ সালে চট্রগ্রাম নার্সিং ইনস্টিটিউট (বর্তমান চট্রগ্রাম নার্সিং কলেজ)(এটাচ্ড টু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) থেকে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সম্পন্ন করেন। পরে ১৯৭৯ সালে একই ইন্সটিটউট থেকে সার্টিফিকেট ইন মিডওয়াইফারি কোর্সও সম্পন্ন করেন। ১৯৮৩ সালে কলেজ অব নার্সিং, মহাখালী হতে ৮ম পজিশনে ব্যাচেলর অব নার্সিং সায়েন্স (বি.এসসি নার্সিং) কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৯০ সালে কুইন মার্গারেট কলেজ, ইডেনবার্গ, ইউকে হতে ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি হেলথ কেয়ার কোর্সের উপর ডিগ্রি লাভ করেন। নার্সিংয়ের উপর প্রবল ইচ্ছা শক্তি অার অাস্থার উপর বিশ্বাস রেখে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনে তিনি যথেষ্ট অবদান রাখেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৯১ সালে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেষ্টার, ইউ কে থেকে (Passed with distinction) সহ মাষ্টার্স ইন এডুকেশন ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
সবশেষে ২০১৫ সালে অামেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, USA থেকে পিএইচডি (Phd in Health & Medical Science)ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যাপক ড.নীলিমা মজিদ কর্মজীবনের শুরুর দিকে সিনিয়র স্টাফ নার্স নোয়াখালী জেনারেল সদর হসপিটালে যোগদান করেন এবং ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেন এবং পরে ১৯৮৬ হতে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সিলেট এম এ জি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৭ সাল হতে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নার্সিং সুপারভাইজার হিসেবেও তিনি কর্মরত ছিলেন। শিক্ষকতা পেশার প্রতি প্রবল অাগ্রহে ড.নীলিমা মজিদ ১৯৯১ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রভাষক হিসেবে কলেজ অব নার্সিং, মহাখালী, ঢাকায় যোগদান করেন এবং ১৯৯৮সাল পর্যন্ত সেখানে অধ্যাপনা করেন।
পরবর্তীতে সিলেট নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্টা হলে (বর্তমান সিনাক) তিনি ১৯৯৮ সাল হতে ২০০৯ পর্যন্ত নার্সিং ইন্সট্রাকটর হিসেবে কাজ করেন এবং ২০০৯ হতে ২০১০ সাল পর্যন্ত বেশ কিছুদিন অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। পরবর্তীতে সরকারি চাকুরি হতে অবসর নিয়ে তিনি সিলেটের বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী নার্সিং কলেজে (২০১০-২০১৫) অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং উপাধ্যক্ষ হিসেবেও বেশ সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কর্মদক্ষতা অার কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়লে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালস্থ সিলেট উইমেন্স নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্টা হলে উনাকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ইন্সটিটিউট’র শুভ সূচনা হয়। তিনি সেখানে ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নিলেও কর্তৃপক্ষ উনাকে কিছুদিনের জন্য বিদায় দিলে পরবর্তীতে অাবারও ২০২১ সালের নভেম্বরে তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অধ্যক্ষের গুরুদায়িত্ব পালন করে সিলেট উইমেন্স নার্সিং কলেজ (সিউনাক) থেকে অানুষ্ঠানিক অবসর গ্রহণ করেন ।
শিক্ষকতার মহান ব্রত হয়ে তিনি জাতীয় পর্যায়ে “শ্রেষ্ট শিক্ষক ২০০৩ ” স্বর্ণ পদক লাভ করেন। জাতীয় পর্যায়ে Teachers Development Programme’ এ তিনি Training Coordinator হিসেবেও কাজ করেছেন এবং জাতীয় শিক্ষা কোর গ্রুপ ২০০৯ এ সদস্য এওয়ার্ড হিসেবেও ভূষিত হয়েছেন।
এছাড়াও তিনি দেশ বিদেশে বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে সম্মানের সহিত ভূমিকা পালন করেছেন তন্মধ্যে TOT(Training of Trainers) “Course on developing nurse educators, competency in improving the quality of nursing education & nursing services “থাইল্যান্ডে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন এবং দেশে বিভিন্ন শর্ট কোর্সে তাঁর অংশগ্রহণ ছিলো চোখে পড়ার মতো Educational Science & Teaching Methodology,(Centre for Medical Education), Dhaka & Nursing Management & Supervision (N I, CMC) ছিলো অন্যতম।
নার্সিং পেশার প্রতি ঠান, ভালোবাসা অার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে ২০০৩ সালে তিনি” Bangla text book of Midwifery” বই প্রকাশ করেন। উনার ছাত্ররা কানাডা, অামেরিকা, লন্ডন, সাইপ্রাস সহ বিভিন্ন দেশে সুনামের সাথে দায়িত্বপালন করেছেন এবং দেশে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী সরকারি/বেসরকারী হাসপাতাল ও বিভিন্ন নার্সিং কলেজে সুনামের সাথে কর্মরত অাছেন।
উনার এই মহান কর্মময় জীবনে অামরা তাঁকে একজন অাদর্শ শিক্ষক, অাদর্শ মা হিসেবে পেয়েছি। এমন গুরুজন পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। ম্যাডামের অবসর জীবন সুন্দর হোক, সফল হোক। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে মহান সৃষ্টিকর্তা অাপনাকে ক্ববুল করুক। অাপনার উত্তরোত্তর উন্নতি,সফলতা অার সুস্থতা কামনা করি, আ-মিন।