মুসলিম মনীষীদের আত্মপর্যালোচনা
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
মুহাসাবা শব্দটি আরবি। এর বাংলা অর্থ আত্মপর্যালোচনা। পরিভাষায়, পরকালীন জবাবদিহিতার প্রতি লক্ষ রেখে প্রতিদিনের কৃত অপরাধ ও ভালো-মন্দ নিয়ে নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া করার নামই মুহাসাবা বা আত্মপর্যালোচনা। ইমাম মাওয়ারদি (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত রাতের কোনো এক সময়ে তার দিনের কাজগুলো যাচাই-বাছাই করা। যদি ভালো ও প্রশংসনীয় কোনো কাজ থাকে তাহলে তা নিয়মিত আমলে রাখবে। আর কাজগুলো যদি নিন্দনীয় হয় তাহলে যথাসম্ভব তার প্রতিকার করবে এবং ভবিষ্যতে এ জাতীয় কাজ থেকে বিরত থাকবে। (আদাবুদ্দুনইয়া ওয়াদদ্বিন, পৃষ্ঠা ৪৫৩-৪৫৪)
নিজেকে নিয়ে সমালোচনার এই চর্চা মুমিনকে অনেক ক্ষেত্রে চরম পদস্খলন থেকে রক্ষা করে। আত্মোন্নয়নে সহায়তা করে। তা ছাড়া ইসলামে মুহাসাবার বিশেষ গুরুত্ব আছে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিত আগামীকালের জন্য (অর্থাৎ আখিরাতের জন্য) সে কী প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মতো হইয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদের আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ১৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে মনোবৃত্তির অনুসরণ করে এবং অলীক কল্পনায় ডুবে থাকে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৯)
মনীষীদের আত্মপর্যালোচনা
পুণ্যবাণ মনীষীরা আত্মপর্যালোচনা করেছেন। নিম্নে তাদের জীবনে মুহাসাবা বা আত্মপর্যালোচনার কয়েকটি চিত্র তুলে ধরা হলো—
ওমর ফারুক (রা.)-এর মুহাসাবা : ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) বলেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ করো, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার আগেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা পরিমাপ করে নাও চূড়ান্ত দিনে পরিমাপ করার আগেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আখিরাতের কঠিন মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদের সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৯)
হানজালা আল-উসাইদি (রা.)-এর মুহাসাবা : হানজালা আল-উসাইদি (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অহির লেখক। তিনি বলেন, একবার তিনি কাঁদতে কাঁদতে আবু বকর (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আবুবকর (রা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে হানজালা, তোমার কী হয়েছে? তিনি বললেন, হে আবু বকর, হানাজালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে। আমরা যখন রাসুল (সা.)-এর দরবারে অবস্থান করি এবং তিনি আমাদের জান্নাত-জাহান্নাম স্মরণে নসিহত করেন, তখন মনে হয় যেন আমরা সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে দেখছি। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার পর স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং অনেক কিছুই ভুলে যাই। আবু বকর (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! আমাদেরও তো একই অবস্থা! চলো আমরা রাসুল (সা.)-এর নিকটে যাই। অতঃপর আমরা সেদিকে রওনা হলাম। রাসুল (সা.) তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হানজালা, কী খবর? তখন জবাবে তিনি অনুরূপ বক্তব্যই পেশ করলেন। রাসুল (সা.) বললেন, আমার কাছ থেকে তোমরা যে অবস্থায় প্রস্থান করো, সর্বদা যদি সেই অবস্থায় থাকতে তাহলে ফেরেশতারা অবশ্যই তোমাদের মজলিসে, বিছানায় এবং পথে-ঘাটে তোমাদের সঙ্গে মুসাফাহা করত। হে হানজালা, সেই অবস্থা তো সময় সময় হয়েই থাকে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৭৫০)
ইবনুল জাওজি (রহ.)-এর মুহাসাবা : আল্লামা ইবনুল জাওজি (রহ.) নিজের সম্পর্কে বলেন, একদিন আমি একজন অনুসন্ধানী গবেষকের ভঙ্গিতে আমার নফসকে (অন্তরকে) নিয়ে চিন্তা করলাম। ফলে আল্লাহর দরবারে তার হিসাব হওয়ার আগে আমি নিজে তার হিসাব নিলাম এবং আল্লাহর দরবারে তার ওজন হওয়ার আগে আমি তাকে ওজন করলাম। আমি দেখলাম, সেই শৈশব থেকে আজ অবধি আল্লাহর অনুগ্রহ আমার ওপর একের পর এক অবতীর্ণ হচ্ছে। আর আমার মন্দ কার্যাবলি তিনি গোপন রেখেছেন এবং যে ক্ষেত্রে (দুনিয়াতেই) শাস্তি দেওয়া আবশ্যক ছিল সে ক্ষেত্রে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অথচ সে জন্য একটু মৌখিক শুকরিয়া ছাড়া আমি আর কিছুই করিনি।
আমি আমার পাপগুলো নিয়ে ভেবে দেখলাম, তার কয়েকটির জন্যও যদি আমাকে শাস্তি দেওয়া হতো তবে দ্রুতই আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম। যদি মানুষের সামনে তার কিছু প্রকাশ পেত তবে আমি লজ্জায় শেষ হয়ে যেতাম। এসব কবিরা গুনাহের কথা শুনে একজন বিশ্বাস পোষণকারী আমার বেলায়ও ঠিক তা-ই বিশ্বাস করত, যা ফাসেক-ফাজেরদের বেলায় বিশ্বাস করা হয়। (অর্থাৎ আমাকেও একজন পাপাচারী ফাসেকের অন্তর্ভুক্ত করা হতো); বরং আমার বেলায় তা আরো নিকৃষ্ট হিসেবে বিবেচনা করা হতো আর আমি (আত্মপক্ষ সমর্থনে) তার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করতাম। এরপর আমি এই বলে দোয়া করি, ‘হে আল্লাহ, তোমার প্রশংসার খাতিরে এবং আমার গুনাহের ওপর তোমার গোপনীয়তার আচ্ছাদনের বদৌলতে তুমি আমাকে মাফ করে দাও।’ তারপর আমি আমার নফসকে আল্লাহর এত বড় ও বেশি অনুগ্রহের জন্য তার শুকরিয়া আদায় করতে আহ্বান জানালাম। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও যেমন শুকরিয়া আদায় করা উচিত ছিল তেমনটা হলো না। ফলে আমি আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গুনাহের জন্য মাতম করতে শুরু করি এবং বড়দের আসন লাভের প্রত্যাশা করতে থাকি। কিন্তু আমার আয়ুকাল শেষ হয়ে গেল, অথচ সে প্রত্যাশা পূরণ হলো না। (সায়দুল খাতির, পৃষ্ঠা ৪৭১)
মহান আল্লাহ আমাদের প্রতিনিয়ত ভালো-মন্দ বিষয়ে আত্মপর্যালোচনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন