যাদুকাটা নদীর তীরে দুই মহাসাধকের ধর্মীয় উৎসব শুরু

জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া, তাহিরপুর :
সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীর তীরে দু’আধ্যাত্মিক মহাসাধকের দুই ধর্মীয় উৎসব শুরু হয়েছে রোববার (১৯ মার্চ) থেকে। চলবে ২১ মার্চ মঙ্গলবার পর্যন্ত। উৎসবের একটি হল-মুসলমানদের হযরত শাহ আরোফিন (র.)-এর ওরস মোবারক; অন্যটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পনাতীর্থ বা গঙ্গাস্নান।
পনাতীর্থ বা গঙ্গাস্নান রোববার দিবাগত রাত ৯টা থেকে শুরু হবে আর আরেফিনের (র.) ওরস মোবারক রোববার বিকেল থেকে মিলাদ মাহফিলের মধ্যদিয়ে।
ছয়শ বছরের অধিক সময় ধরে সম্প্রীতির দুই উৎসব আসছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী যাদুকাটা নদীর দুই তীরে রাজারগাঁও ও লাউড়েরগড় গ্রামে চলছে।
এ উৎসবকে সামনে রেখে যাদুকাটা নদীর দুই তীরে ভক্তগণের আগমনে মিলনমেলায় পরিপূর্ণ হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে রাজারগাঁও ও লাউড়েরগড় গ্রাম ও আশপাশের এলাকায়। তবে সকাল থেকে বৃষ্টি ও ঠান্ডা বাতাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন আগতরা।
এ উৎসবকে ঘিরে হযরত শাহ্ আরেফিনের (র.) আস্তানাসহ উভয় ধর্মের লোকজন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
অতিরিক্ত নিরাপত্তার লক্ষ্যে পুরো এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত পুলিশ, বিজিবি, আনসার, পরিচালনা কমিটির লোকসহ স্থানীয় শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক নিরাপত্তা সহকারী হিসেবে কাজ করে যাবে।
অন্যদিকে, হযরত শাহ্ আরেফিন (র.) ওরসের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, ভাণ্ডারি, পল্লীগীতি, লালনগীতি, মোর্শেদী, বাউলসংগীত, জেলার মরমী কবি সাধক হাছন রাজা এবং বাউলসম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমের লোকসংগীতে মেতে থাকবে ওরসস্থল।
এছাড়া, গঙ্গাস্নান যাত্রাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী ও পৃথকভাবে মঙ্গল আরতি, ভজন, লীলা কীর্তন, বৈদিক নাটক, গঙ্গাপূজা, দেশের বেতার, টিভি ও মঞ্চ শিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
শাহ আরেফিন (র.) মোকাম পরিচালনা কমিটি সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক আলম সাব্বির জানান, এই দুই উৎসবের মধ্য দিয়ে দু’ধর্মের দু’আধ্যাত্মিক মহাসাধকের দেশ, বিদেশসহ সিলেট বিভাগের সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জসহ লাখ লাখ ভক্তবৃন্দের আগমনে মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। যাদুকাটা নদীর দুই-তীর রাজারগাঁও ও লাউড়েরগড়ে বসেছে বিরাট বারুণী মেলা। মেলায় ঢল নেমেছে শিশু, নারী, পুরুষসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের।
শাহ আরেফিন (র.) মোকাম পরিচালনা কমিটি সহসভাপতি ও বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন বলেন, হযরত শাহজালালের ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে শাহ আরেফিন (র.) ছিলেন অন্যতম। সবাই জানেন তিনি একজন জিন্দাপীর। মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা তাদের মনোবাসনা পূরণ ও সিদ্ধিলাভের আশায় শাহ আরেফিনের (র.) ওরসে আসেন। তিনি ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের বড়বড় পাথরের গুহায় বসে আল্লাহর ইবাদত করতেন। ওটাই ছিল তার একমাত্র আস্তানা (তখনকার সময়ে বাংলাদেশের অংশ ছিল) বাংলাদেশে কোন আস্তানা নেই। কিন্তু ভারতের সেই আস্তানায় ভক্তদের যেতে দেয় না ভারতীয় বিএসএফ। তাই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের লাউড়েরগড় এলাকায় জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন স্থানে শাহ আরেফিনের আস্তানা তৈরি করে সেখানেই ওরস পালন করে ভক্ত আশেকানরা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও শাহ আরেফিনের আস্তানার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথা হয়েছে কোন অনিয়ম হলে আইনগত ব্যবস্থা নেবে তারা।
অদ্বৈত প্রভু জন্মধামের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল জানান, এখানে না আসলে জীবনের পূর্ণতা আসে না। প্রতি বছরের চৈত্র মাসে এই তিথিতে গঙ্গাস্নানের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যাদুকাটা নদীতে ছুটে আসেন। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা যাদুকাটা নদীতে গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে তাদের সারা বছরের পাপ মোচনসহ পুণ্য লাভের জন্য এখানে আসেন মা, বাবা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। ১৫১৬ খিষ্টাব্দে পনাতীর্থের সূচনা করেন মহাপুরুষ শ্রীমান অদ্বৈত আর্চায প্রভু। নদীর তীর সংলগ্ন রাজারগাঁও গ্রামে অদ্বৈত আর্চায মন্দির ও আখড়া তৈরি করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এই উৎসবে দেশে-বিদেশের লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী ও আশেকানদের আগমন ও নিরাপদে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে আমাদের পক্ষ থেকে এছাড়া প্রশাসনও আছে আমাদের সাথে। এ বছর স্নানযাত্রার মুখ্য সময় নির্ধারিত হয়েছে ৪ চৈত্র, ১৯ মার্চ রোববার মহাগঙ্গা স্নান: রাত ০৯/৪৫/১৫ গতে রাত ৪/০৬/৫০ পর্যন্ত।
তাহিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সৈয়দ ইফতেখার হোসেন জানান, শাহ আরেফিন (র.) মোকাম ও পনাতীর্থ এলাকায় ও আসা-যাওয়ার পথে সকল প্রকার অনিয়ম ও আইনশৃঙ্খলা বজার রাখার জন্য সর্তক অবস্থানে আছি। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুপ্রভাত চাকমা জানান, দু-ধর্মের দুটি মেলায় আসা লোকজনের নিরাপত্তার জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এবং যেকোন অনিয়মে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।