রমজানে চাঁদ দেখার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
বছর ঘুরে শুরু হয়েছে রমজান। রমজানের নতুন চাঁদ ঘিরে আছে ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকোজ্জ্বল অধ্যায়। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে তা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর অভিন্ন সংস্কৃতি রমজানের চাঁদ দেখা। বর্তমানে একটি কমিটির মাধ্যমে চাঁদ দেখার দায়িত্ব পালন করা হয়। তারাই চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করে এবং চাঁদ ওঠার ঘোষণা দেয়।
চাঁদ দেখার আনুষ্ঠানিকতা : হিজরি বর্ষপঞ্জি চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। চন্দ্রদর্শনের মধ্য দিয়ে রমজান মাস শুরু হয়। তাই চাঁদ দেখার সাক্ষ্য সাব্যস্ত হওয়ার জন্য সত্যবাদী মুসলিম হওয়া আবশ্যক। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং তা দেখে রোজা ভাঙো। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে তোমরা শাবান মাসের ৩০ দিন পূর্ণ কোরো।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০০)
চাঁদ দেখতে বিচারকের উপস্থিতি : ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই চাঁদ দেখার ঐতিহ্য চলে আসছে। তবে আব্বাসি যুগ থেকে বিচারকরা চাঁদ দেখার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তাঁরা চাঁদ দেখার সাক্ষ্য নথিবদ্ধ করে রাখতেন। ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান (মৃত্যু ৬৮১ হি.) তাঁর ওয়াফায়াতুল আয়ান গ্রন্থে লিখেছেন, ১৫৫ হিজরিতে খলিফা আল-মানসুর মিসরের বিচারক হিসেবে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন লাহিয়াহ আল-হাজরামিকে নিযুক্ত করেন। তিনিই প্রথম বিচারক, যিনি রমজানের চাঁদ দেখার জন্য বের হন। এই রীতি (অন্তত) হিজরি সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত চালু ছিল।
ইবনে বতুতার বর্ণনায় রমজানের চাঁদ : ৭২৫ হিজরিতে বিশ্বপরিব্রাজক ইবনে বতুতা মিসরে যান। সেখানকার আবয়ার শহরে এসে তিনি রমজানের চাঁদ দেখার আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেন। তিনি ছিলেন বিচারক ইজ্জুদ্দিন আল-মালিহি (রহ.)-এর অতিথি। ইবনে বতুতা তাঁর বিখ্যাত রিহলা গ্রন্থে লিখেছেন, সেদিন সবার মতো আমিও রমজানের চাঁদ দেখতে বের হই। নিয়ম ছিল, শাবান মাসের ২৯তম দিন আসরের পর শহরের ফকিহ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিচারকের বাড়িতে উপস্থিত হন। সবাইকে নিয়ে বিচারক পদযাত্রা শুরু করেন। তাদের পেছনে থাকত শহরের পুরুষ, নারী, শিশু, কিশোর দাসসহ সব বয়সী লোক। শহরের বাইরের একটি উঁচু স্থানে গিয়ে তারা চাঁদ অনুসন্ধানের কার্যক্রম পরিচালনা করে। স্থানটি আগে থেকেই কাপড় বিছিয়ে প্রস্তুত করা হতো। সেখানে বিচারকসহ সবাই চাঁদ দেখে মাগরিবের নামাজ পড়ে শহরে ফিরতেন। তখন তাঁদের হাতে থাকত মোমবাতি, ঝাড়বাতি ও ফানুসসহ নানা সামগ্রী। এদিকে বাগদাদের বিচারকরা অন্যদের মতো চাঁদ দেখার জন্য নিজেরা বের হতেন না; বরং স্বচক্ষে দেখা সাক্ষ্যের ওপরই নির্ভর করতেন। ঐতিহাসিক আজ-জাহাবি (মৃত্যু ৭৪৮ হি.) তাঁর তারিখুল ইসলাম গ্রন্থে বলেছেন, ৬২৪ হিজরিতে প্রধান বিচারক ইমাদুদ্দিন আবু সালেহ নাসার বিন আবদুর রাজ্জাক আল-জিলি বাগদাদের দুই ব্যক্তির সাক্ষ্যদানের ওপর নির্ভর করতেন।
চাঁদ দেখা নিয়ে বিড়ম্বনা : অবশ্য মেঘের কারণে চাঁদ নিয়ে অনেক বিড়ম্বনার ঘটনাও রয়েছে। ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান (রহ.) বর্ণনা করেছেন, আনাস বিন মালিক (রা.) একদল লোকের সঙ্গে চাঁদ দেখতে বের হয়েছেন। তখন আনাস (রা.)-এর বয়স এক শ বছর ছুঁই ছুঁই। তিনি চাঁদ দেখেছি বলে এক দিকে হাত দিয়ে ইশারা করেন। কিন্তু কেউ তা দেখতে পায়নি। তখন বসরার বিচারক ইয়াস বিন মুয়াবিয়া আল-মাজানি তাকিয়ে দেখলেন, আনাস (রা.)-এর ভ্রুর একটি চুল চোখের দিকে এসে পড়েছে। ইয়াস তা সরিয়ে তাঁর ভ্রু সোজা করে দেন এবং বলেন, হে আবু হামজা, এখন চাঁদের স্থানটি দেখাও। তখন আনাস (রা.) তাকিয়ে বললেন, এখন তো দেখছি না! (ওয়াফায়াতুল আয়ান ওয়া আনবায়ি আবনায়িজ জামান, ২৫০/১)