রোজা এলো যেভাবে
মুফতি হুমায়ুন আইয়ুব
রোজা ফার্সি শব্দ। সাউম বা সাওম আরবি শব্দ। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূলভিত্তির একটি রোজা। সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার, পাপাচার, কামাচার এবং সে সঙ্গে যাবতীয় ভোগবিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোজা। ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমজান মাসের প্রতিদিন রোজা রাখা ফরজ।
রোজার শুরু হজরত আদম (আ.) থেকে। তিন দিন তাদের ওপর রোজা ফরজ ছিল। হজরত আদমের উম্মতরা চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা পালন করত। রোজার এই ফরজ বিধান ধারাবাহিকভাবে হজরত নুহ (আ.) পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মেও রোজার প্রচলন ছিল। বিশেষভাবে ইহুদিরা সপ্তাহে শনিবার, বছরের মহররমের ১০ তারিখ রোজার বিধান কার্যকর ছিল। অবশ্য হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর তাওরাত নাজিলের আগে তুর পাহাড়ে আসা-যাওয়ার চল্লিশ দিনও ইহুদিরা রোজায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। হজরত ঈসা (আ.) ইঞ্জিল পাওয়ার আগে দীর্ঘ চল্লিশ দিন সিয়াম মগ্ন ছিলেন। হজরত দাউদ (আ.) একদিন পর পর রোজা পালন করতেন। বোখারি : ৩২৩৭
হিন্দুরাও প্রতিটি পূজায় ব্রতী পূজারি ও অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা নারী-পুরুষ উপবাস পালন করে থাকেন। এছাড়াও অমাবস্যা ও পূর্ণিমা ইত্যাদি তিথিতে উপবাস করে থাকেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। হিন্দু ব্রাহ্মণরাও একাদশী ও দ্বাদশীর উপবাস পালন করে থাকেন।
আল্লামা সুলাইমান নদভীর সিরাতগ্রন্থ সূত্রে প্রাচীন মিসরীয়দের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় রোজার সন্ধান মেলে। তাছাড়া পারসিক ধর্মাবলম্বীরাও গুরুত্বসহ রোজা পালন করতেন। হিজরি দ্বিতীয় বছর উম্মতে মুহাম্মদির ওপর রোজা ফরজ করা হয়। কোরআনে বর্ণিত হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হয়েছে, যেমন দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা ১৮৩)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলুসির (র.) তাফসির গ্রন্থ ‘রুহুল মাআনি’তে বলেছেন, ‘পূর্ববর্তীদের’ দ্বারা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হজরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত সব নবী-রাসুলের জামানা বুঝানো হয়েছে। কোরআন ও হাদিস গবেষণা করলে রোজার ইতিহাস সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, মহান আল্লাহ তায়ালা হজরত আদম (আ.) কে জান্নাতে প্রেরণ করে একটি গাছের ফল খেতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিশেষ এক ধরনের রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করলেন। এ ব্যাপারে দয়াময় আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ করেন, হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং সেখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তসহ খেতে থাক, কিন্তু তোমরা এ গাছের কাছে যেও না। (যদি যাও বা তার ফল ভক্ষণ কর) তাহলে জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সূত্র : সূরা বাকারা : ৩৫
আল্লামা ইমাদ্দুদিন ইবনে কাসিরের মতেÑ ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোজা রাখার বিধান ছিল। পরে রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে।
অন্যান্য ধর্মে রোজার বিধান থাকলেও ইসলামের রোজা আর অন্য ধর্মের রোজায় পার্থক্য অনেক। ইহুদি ধর্মে রোজা শোক ও বেদনার প্রতীক। রোজা মুসলমানদের জন্য শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয় : আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের পন্থাও। উন্নত চরিত্র গঠনেরও উপায়। নৈতিকতা ও মানবিকগুণে গুণান্বিত হয়ে গড়ে ওঠার কৌশল। রোজার ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম।
প্রথম রোজায় হজরত ইব্রাহিম আ. সহিফা এবং ৬ রোজায় হজরত মুসা (আ.) তাওরাত লাভ করেন। ১৩ রোজায় ঈসা (আ.)-এর ওপর ইঞ্জিল, ১৮ রোজায় হজরত দাউদ (আ.) জাবুর এবং ২৭ তারিখে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন অবতীর্ণ হয়।
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরের যুদ্ধের সূচনা ১৭ রোজায়। নবীদৌহিত্র হজরত হাসানের জন্ম হয় ১৫ রোজায়। জান্নাতি নারীদের নেত্রী ফাতেমা (রা.)-এর মৃত্যু ৩ রোজায়। হজরত খাদিজা ও হজরত আয়েশা (রা.) এর শেষ বিদায় যথাক্রমে ১০ ও ১৭ রোজায়। ২১ রোজায় শেষ বিদায় নেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা (রা.)। মুসলমানদের রোজা কেবল দিনব্যাপী উপোস থাকার ইতিহাস নয়, বিভিন্ন ঘটনার ইতিহাস ও সামাজিক বন্ধনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও।