ব্রেনের ব্যায়াম! কীভাবে করবেন ?
দৈনিকসিলেটডেস্ক
প্রফেসর ডা. স্টিভেন লরিস নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণায় এ-কালের একজন নেতৃস্থানীয় ও সুপরিচিত গবেষক। দুই দশক ধরে তিনি কাজ করেছেন মস্তিষ্কের বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে। গবেষণা করেছেন মন ও মস্তিষ্কের ওপর মেডিটেশনের ইতিবাচক প্রভাব নিয়েও।
২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার বই দ্য নো-ননসেন্স মেডিটেশন : অ্যা সায়েন্টিস্ট’স গাইড টু দ্য পাওয়ার অব মেডিটেশন। তিনি খুব সুন্দর করে উপমা দিয়েছেন-যখন কেউ নিয়মিত দৌড়ায়, স্বাভাবিকভাবেই তার পায়ের পেশি মজবুত হয়; আবার যখন কেউ সাঁতার কাটে, তার হাতের পেশির শক্তি বাড়ে। তেমনি আমরা যখন মেডিটেশন করি, মস্তিষ্কের ভেতরেও আসে নানা ইতিবাচক পরিবর্তন। মেডিটেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এর চর্চা ব্রেনকে রি-টিউন করে। মেডিটেশন হলো ব্রেনের ব্যায়াম। এই ব্যায়ামের ফলে কী কী উপকার হয় একটু পরে আমরা বলছি। তার আগে একটি গল্প শোনাই।
ইনকাদের দুর্গ শহর মাচু পিচ্চু-তে পৌঁছানো ছিল এক দুঃসাধ্য কাজ। আন্দিজ পর্বতমালার ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত গিরিপথ অতিক্রম করতে হতো প্রথমে। অক্সিজেনের স্বল্পতা সেখানে যে-কারো মাথা ঝিমঝিম করা বা মাথা ঘোরার জন্যে যথেষ্ট, আবার মেঘের ওপরে শহর দেখা যাওয়ার পরও পাথরের তৈরি তিন হাজারটি ধাপ অতিক্রম করেই পৌঁছা সম্ভব হতো শহরের গেটে। ভাবলে অবাক হতে হয় এই রাজধানীর সাথে দুই হাজার মাইলব্যাপী ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি গ্রামের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত রানাররা। এরা খালি পায়েই দৌড়াতে পারত দীর্ঘ পথ। কখনো কখনো এরা প্রতিদিন দৌড়াতো ৫০ থেকে ৭৫ মাইল পর্যন্ত-ম্যারাথন দৌড়ের ২/৩ গুণ। কখনো কখনো তাদের পথ শুরু হতো পর্বত চূড়া থেকে। উঠতে হতো মাইলখানেক ওপরে।
এদের কষ্ট সহ্য ক্ষমতা ও গতি এককথায় বলা যেতে পারে অতিমানবিক। এরাই ছিল সম্রাট আতাহুলপার চোখ এবং কান। স্প্যানিশ লুটেরাদের আক্রমণ অভিযানে আগমনের কথা এই পরিশ্রমী ও অতি কষ্টসহিষ্ণু রানাররা এসে সম্রাটকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু আক্রমণ মোকাবেলায় সম্রাটের কোনো সুসংহত প্রস্তুতি ছিল না। তাই ১৫৩২ সালে ইনকাদের এই রাজধানীর পতন ঘটে। বিশ্বাসঘাতকতার পন্থা অবলম্বন করে স্প্যানিশ লুণ্ঠনকারীদের নেতা পিজারো সম্রাট আতাহুয়ালপাকে অপহরণ করে বিপুল ধনরত্ন মুক্তিপণ আদায় করার পর হত্যা করে। ইনকা সভ্যতার পতন ঘটে।
প্রফেসর ডা. স্টিভেন লরিস
আপনি যদি ব্রেনকে আন্দিজ পর্বতমালার শীর্ষে অবস্থিত মাচু পিচ্চু দুর্গ ভাবেন, তাহলে দেখবেন যে, এরও রয়েছে অসংখ্য পরিশ্রমী রানার। যারা নিরলসভাবে দেহ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দূরবর্তী প্রান্ত থেকে বাণী বহন করে ব্রেনে পৌঁছাচ্ছে এবং ব্রেন থেকে কমান্ড পৌঁছে দিচ্ছে পায়ের আঙুলের মতো দূরবর্তী প্রান্তে। এই রানাররা হচ্ছে নিউরোট্রান্সমিটার অণু। এই নিউরোট্রান্সমিটার অণুগুলো প্রতিটি দেহকোষের জীবনকে প্রভাবিত করছে। ব্রেনের সকল চিন্তা, আশা, স্বপ্ন, ইচ্ছা, অনিচ্ছা, করণীয়, বর্জনীয় সকল নির্দেশ প্রতিটি সেলে পৌঁছে দিচ্ছে এই নিউরোট্রান্সমিটার। আবার দেহাভ্যন্তরের ও পারিপার্শ্বিকতার সকল তথ্য ব্রেনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে এই নিউরোট্রান্সমিটার। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ৫০ ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার শনাক্ত করেছেন।
আমরা জানি, আমাদের জীবন ধারণের জন্যে অত্যাবশ্যক প্রাণ-রাসায়নিক প্রক্রিয়া চালু রাখার পুরো কাজই করে ব্রেন। এ প্রক্রিয়া যেমন জটিল তেমনি একটির সাথে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং নির্ভরশীল। এর যে-কোনো পর্যায়ে সমন্বয়ের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি পুরো প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। যেমন-রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া না থাকলে আমরা খাদ্য হজম এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে দেহের সর্বত্র প্রেরণ করতে পারতাম না। আবার আমরা যদি খাবার শনাক্ত করতে ব্যর্থ হতাম অথবা শনাক্ত করতে পারলেও যদি সঠিকভাবে হাত ব্যবহার করে তা ধরে ঠিকমতো দুই ঠোঁটের মাঝখানে মুখে প্রবেশ করাতে না পারতাম, তাহলে আমাদের হজম প্রক্রিয়াও কোনো কাজে আসত না। কিন্তু আমরা কোনোরকম চিন্তা না করেই অবলীলায় সামনের খাবার তুলে মুখে দিয়ে চিবানোর সাথে সাথে মুখের গ্রন্থিগুলো লালা নিঃসরণ শুরু করে দেয় আর আমরা কোনো সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়া তা গলাধঃকরণ করে পাকস্থলীতে পাঠিয়ে দেই।
ব্রেন সেলগুলো যে বৈদ্যুতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে যে কত সংখ্যক নিউরোন সেলের পারস্পরিক যোগাযোগ প্রয়োজন হয় তা কল্পনা করতে গেলেও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। জার্মানির বিখ্যাত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ম্যানফ্রেড ইগান নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ব্রেনের কোনো কোনো কেমিক্যাল রি-একশন সংঘটিত হতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ডের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়। তিনি বলেছেন, একটি দ্রুতগামী গাড়ির নিচে পড়া থেকে বাঁচার জন্যে এক পা পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া ও তা কার্যকর করার জন্যে এক লক্ষ নিউরোনের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হয় এবং পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে।
এত চমৎকার ব্যবস্থা থাকতেও দেহ কখনো কখনো কেন রোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়, কেন পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ বা সাফল্য অব্যাহত রাখতে পারে না? এ প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করা যেতে পারে-ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা এত নিবেদিতপ্রাণ রানারদের আগাম সতর্কবাণীর পরও কেন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন? জবাব একটাই-সুসংহত মানসিক প্রস্তুতির অভাব। আমরা জানি মনের শক্তির অসীমতা। আমরা জানি বস্তু বিনাশ প্রাপ্ত হয়। কিন্তু তথ্য অবিনাশী। দেহকোষ মরে যায়। কিন্তু এর অভ্যন্তরের তথ্য ডিএনএ বেঁচে থাকে নতুন দেহকোষে। চিন্তা সর্বত্রগামী। আবার চিন্তার রয়েছে বস্তুগত ভিত্তি। (কারণ প্রতিটি নিউরোট্রান্সমিটার এক একটি বিশেষ ধরনের চিন্তা বা তথ্যকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। আর নিউরোট্রান্সমিটার একটি বিশেষ ধরনের রাসায়নিক অণু।) তাই মন ও চিন্তার শক্তি সবকিছুকেই প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। যদি আমরা মন ও চিন্তার শক্তিকে সৃজনশীল ও ফলপ্রসূভাবে ব্যবহার করতে পারি, সুসংহত মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি, তাহলে চিন্তা যেমন বস্তু সৃষ্টি করছে, চিন্তা তেমনি সুখ ও সাফল্য সৃষ্টি করবে।
মানুষের সকল চিন্তা ও সচেতনতার কেন্দ্র হচ্ছে ব্রেন। মানুষের সকল উদ্ভাবনী দক্ষতার উৎস হচ্ছে ব্রেন। ব্রেনের এই দক্ষতার কারণে মানবজাতির পূর্বপুরুষরা দৈহিকভাবে তার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাভূত করে শুধু টিকেই থাকে নি, বরং প্রাণিকুলের মাঝে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্রেনই মানুষকে প্রথম পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে শিখিয়েছে। আর সেই ব্রেনের জেনেটিক উত্তরসূরিরাই বানিয়েছে মহাশূন্য যান। মানুষ অতীতে যা করেছে, ভবিষ্যতে যা করবে তা এই ব্রেনেরই ফসল। দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ব্রেন। হার্টকে বলা যেতে পারে একটা পাম্প মেশিন। ফুসফুসকে বলা যেতে পারে অক্সিজেন সমৃদ্ধকরণ যন্ত্র। কিন্তু মানুষের প্রতিটি কাজের পেছনে নিয়ন্ত্রক শক্তি হচ্ছে ব্রেন। ব্রেনই মানুষকে ‘মানুষ’ বানিয়েছে। বিশ্বে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ব্রেনের কারণেই। এমআইটি-র নিউরোসায়েন্টিস্ট প্রফেসর ফ্রান্সিস স্মিথের ভাষায়, মানুষ যদি আবিষ্কার করতে পারে কেন সে অনন্য, তাহলে হয়তো সে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে না। বরং এখনকার চেয়ে নিজেকে বেশি শ্রদ্ধা করবে।
আর এই অনন্যতার প্রধান সম্পদ বা উপকরণ হলো ব্রেন। ব্রেন অনেক অনেক সূক্ষ্ম কাজ অনায়াসে সম্পন্ন করে। মানুষের হার্ট ও দম মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, গরম কিছুতে ছ্যাকা লাগার সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিতে সাহায্য করে ব্রেন। তাছাড়া এ নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হচ্ছে মানুষের সচেতনতার অজ্ঞাতে। তাছাড়া ব্রেন নিজেকে নিজে মেরামত করতে পারে। ব্রেন নষ্ট হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রেনের কোনো কোনো অংশ অপর অংশের কাজ রপ্ত করতে ও পরিচালিত করতে শিখতে পারে, যা কম্পিউটার পারে না। কম্পিউটারকে সুইচ অফ করে বন্ধ করে দেয়া যায়, কিন্তু ব্রেনকে বন্ধ করার উপায় নেই। আপনি কাজ করুন বা ঘুমিয়ে থাকুন ব্রেন সবসময়ই সক্রিয় থাকে। ব্রেন কখনো ক্লান্ত হয় না। ২৪ ঘণ্টা কাজ করে। গভীর ঘুমের সময়ও ব্রেন সক্রিয় থাকে।
জন্ম থেকে যে সক্রিয় অঙ্গটিকে উপহার হিসেবে আমরা পেয়েছি, একে আরো সক্রিয়, শক্তিশালী হিসেবে বজায় রাখার জন্যে সহায়ক হচ্ছে মেডিটেশন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কয়েক ডজন ল্যাবরেটরিতে মনোবিজ্ঞানী, প্রাণিবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্রেনের ওপর মেডিটেশনের সুপ্রভাব নিয়ে। ৩ এপ্রিল ২০২১ যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী নিউ সায়েন্টিস্টকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্টিভেন লরিস বলেন, মেডিটেশন চর্চাকারীদের ব্রেন-স্ক্যান করে দেখা যায়, দীর্ঘদিন নিয়মিত মেডিটেশনের ফলে গ্রে ম্যাটারের পরিমাণ বাড়ে, যা মনোযোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সেইসাথে বিস্তৃত হয় ব্রেনের হিপোক্যাম্পাস অংশ, যা স্মৃতিশক্তির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগেন এই ভেবে যে, তার স্মৃতিশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা সমবয়সী বন্ধু বা সহপাঠীদের চাইতে অনেক কম। তাই জীবনে বড় কিছু করার যোগ্যতা হয়তো তার নেই! কিন্তু মেডিটেশন করে তিনি এই হতাশা থেকেও বেরিয়ে আসতে পারেন। তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহে সাহায্য করাই মস্তিষ্কের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিপোক্যাম্পাস-এর কাজ। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েসের প্রফেসর আর্ট ক্রেমার বলেন, হিপোক্যাম্পাসের আকার যত বড় ও সুগঠিত, তত বেশি স্মৃতি সংরক্ষণ ও নতুন স্মৃতি তৈরি সম্ভব। আর নিয়মিত মেডিটেশনে এই হিপোক্যাম্পাস অংশটিই বড় হয়, হয় শক্তিশালী, মজবুত।
নিয়মিত মেডিটেশনে পরিবর্তন আসে ইনসুলার কর্টেক্স ও লেফট প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স-এ, যা আমাদের অনুভূতি এবং আবেগের ভারসাম্য বজায় রাখে। মানব মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স। এর বাম দিকটি যাদের বেশি সক্রিয় তারা সুখী। ডান দিকটি বেশি সক্রিয় যাদের তারা কিছুটা মনমরা, বিষণ্ন। ইইজি ও এমআরআই-এর সাহায্যে নিয়মিত মেডিটেশন চর্চাকারী সন্ন্যাসীদের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের বাম দিকটি তুলনামূলক বেশি সক্রিয়। তারা ইতিবাচকতায় উদ্দীপ্ত এবং নেতিবাচক আবেগের মুখে ততটাই দৃঢ়, অটল।
এখন সন্ন্যাসী শুনে ভাববার দরকার নেই যে, আমরা যারা গৃহী, ঘর-সংসার করি, তাদের ক্ষেত্রে কী উপকার হবে? এখানে যারা মেডিটেশনের উপকার নিয়ে বলেছেন তারা সবাই গৃহী। কেউ শিক্ষার্থী, কেউ গৃহিণী, কেউ পেশাজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ উদ্যোক্তা। তাদের সবাই দিনে অন্তত একবার হলেও মেডিটেশন করেন। গবেষকরা জানাচ্ছেন, মেডিটেশনের সুফল পেতে গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীদের মতো এটি সারাদিন চর্চা করতে হবে তা নয়, দিনে ১৫ থেকে ৩০ মিনিট মেডিটেশন বা ধ্যানচর্চাও এনে দিতে পারে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।
তাই নিয়মিত নিজে মেডিটেশন চর্চা করুন এবং পরিচিতদের মেডিটেশন চর্চায় উদ্বুদ্ধ করুন। তাহলেই আমাদের ‘ভালো মানুষ ভালো দেশ’ এর স্বপ্ন স্বপ্ন থাকবে না, বাস্তবে রূপ নেবে। যারা নিয়মিত মেডিটেশন অনুশীলন করেন প্রতিকূলতা মোকাবেলায় তাদের সক্ষমতা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে গভীর মনোযোগ দেয়ার সামর্থ্য তাদের বেশি। তারা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারেন। আবার অপ্রত্যাশিত পরিবেশগত আনুকূল্য তারা পান বেশি। দুর্বিপাক মোকাবেলার পাশাপাশি রোগব্যাধি থেকেও তারা অন্যদের চেয়ে কম সময়ে নিরাময় লাভ করেন। এ কারণে ক্রনিক রোগের নিরাময়ের জন্যে পাঠ্য বইতে না থাকলেও ডাক্তাররা এখন ক্রনিক রোগীদের প্রেসক্রিপশন করছেন যোগ প্রাণায়াম এবং মেডিটেশন চর্চার।
চীনের স্কুলগুলোতে মেডিটেশন চর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। নতুন স্কুল, নতুন ক্লাস, নতুন সেমিস্টার এবং নতুন সিলেবাস নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে সাধারণ ভীতি কাজ করে, তা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন স্কুলে গঠন করা হয়েছে মেডিটেশন ক্লাব। প্রতি বৃহস্পতিবার এই ক্লাবের সদস্য শিক্ষার্থীরা মেডিটেশন ও অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়। ফলে দেখা গেছে, অন্যান্যদের তুলনায় তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে এবং পরীক্ষায় তাদের ফলাফলও আগের থেকে ভালো।
কোলকাতার সল্টলেকের ভারতীয় বিদ্যাভবন স্কুলে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে পড়ুয়াদের পাঁচ মিনিট মেডিটেশন করাচ্ছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। একেবারে খুদেরাও যেমন রয়েছে, তেমনি বাদ যাচ্ছে না একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পড়ুয়ারাও। স্কুলে মিড টার্ম পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শুরু হয় বেলা ১১টায়। তার আধঘণ্টা আগে সাড়ে ১০টায় প্রার্থনা ও মেডিটেশন শুরু। টানা ৩০ মিনিট চোখ বন্ধ করে ডেস্কের ওপরে দুহাত রেখে পিঠ সোজা করে বসা। কিন্তু চোখ আর কতক্ষণ বন্ধ রাখা যায়? পাশের বন্ধু কী করছে, টিচার কোথায় গেলেন, এগুলো তো দেখতে ইচ্ছে করে। অধ্যক্ষা বলেন, ‘ওরা যে একভাবে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারবে না, সেটা ধরে নিয়েই আমরা এটা শুরু করেছি। তবে ওই যে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল, মনটা একটু শান্ত হলো, সেটাতেও ভালো ফল পাওয়া যাবে।’
পরীক্ষার হলে ঢুকেও বইতে চোখ বুলিয়ে নেয়ার অভ্যাসটা ভালো নয়। ওতে বাচ্চাদের মন আরো চঞ্চল হয় বলে শিশু-মনোবিদরা জানান। সেই জায়গায় ধ্যান ওদের স্থির করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ক্লাসের প্রথম পিরিয়ডের পাঠদানের শুরুতে পাঁচ মিনিটের জন্যে এ অভ্যাসটি করানো হবে বলে অধ্যক্ষা জানান। তিনি বলেন, ‘মিথ্যা কথা বলব না’, ‘সহপাঠীদের সাহায্য করব’-এ ধরনের কিছু কথা ওরা যদি নিয়মিত মনে মনে আওড়ায়, তাহলেও ওদের মনে এর প্রভাব পড়বে।
প্রফেসর ডা. স্টিভেন লরিস-এর সাক্ষাৎকারের কথা বলছিলাম একটু আগে। তিনি সে সাক্ষাৎকারে কোভিড পরবর্তী শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, এই মহামারির প্রভাব থেকে শিশুরাও মুক্ত নয়। তাদেরও স্বাভাবিক প্রাণবন্ত জীবনে ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই মেডিটেশনের শিক্ষা দিতে হবে। আশ্চর্য হলেও সত্য, আমাদের স্কুলগুলোতে জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যে অনেক শিক্ষক আছেন, শারীরিক শিক্ষা ও ফিটনেসের জন্যেও শিক্ষক আছেন, তাহলে মনের যত্ন কীভাবে নিতে হবে সেই শিক্ষা দেয়ার জন্যে কোনো শিক্ষক কেন থাকবেন না? এ বিষয়টি আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত।
যদি আমার কথাই ধরি, আমাকে শেখানো হয়েছে, কীভাবে চিকিৎসক হওয়া সম্ভব। কিন্তু কেউ শেখায় নি কীভাবে আমি নিজেকে ভালো রাখব। মেডিটেশন হয়তো আমাদের চারপাশের ঘটনাগুলোকে বদলে ফেলতে পারবে না। কিন্তু প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত প্রতিটি ঘটনায় আমার দেহ-মন কীভাবে প্রভাবিত হবে, সেই বিষয়টির ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দেবে মেডিটেশন। আমি বিশ্বাস করি, একসময় আমাদের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হবে মেডিটেশন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে ৪৭% ভাগ সময়েই আমরা অপ্রয়োজনীয় নানা চিন্তা, দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকি। আমাদের মন হয় অতীতের না পাওয়া-অতৃপ্তিগুলো নিয়ে আফসোস করতে থাকে অথবা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। অনেক শিক্ষার্থীই আছেন, পড়তে বসলেই তাকে গত পরীক্ষায় খারাপ করার দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে। আবার সামনের পরীক্ষায় খারাপ করলে বাবা-মাকে কী জবাব দেবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা! এই দোটানা চাপের কারণে একদিকে প্রস্তুতি বাধা পড়ে। আবার প্রস্তুতি ভালো থাকলেও নার্ভাসনেসের কারণে পরীক্ষা খারাপ হয়! ২০১৭ সালে ইউনিভার্সিটি অফ রোড আইল্যান্ডে ১৮-২৩ বছর বয়সী একদল শিক্ষার্থীকে বেছে নেয়া হয় গবেষণার জন্যে। সময়টা ছিল ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক ছয় সপ্তাহ আগে, যখন অধিকাংশ শিক্ষার্থীই পরীক্ষা সংক্রান্ত মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তায় বিপর্যস্ত। টানা ছয় সপ্তাহ তাদের নিয়মিত মেডিটেশন অনুশীলন করানো হলো। ফলাফল দেখা গেল, পরীক্ষাভীতি ও নার্ভাসনেস কাটিয়ে আত্মবিশ্বাস ও ফুরফুরে মেজাজে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন তারা!
অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে পুরো শিক্ষার্থী জীবনে সবচাইতে বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় টিনএজ বয়স বা বয়ঃসন্ধিকালে। এসময়ে হরমোনাল চেঞ্জের কারণে শরীর-মনে আসে নানা পরিবর্তন। দেখা দেয় মুড সুইং, হঠাৎ রেগে যাওয়ার প্রবণতা, বিষণ্ণতা। স্কুল-কলেজে বুলিংয়ের মতো অপ্রিয় ও অপ্রত্যাশিত ঘটনাও কারো কারো সাথে ঘটে থাকে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৫০% টিনএজারই ডিপ্রেশনের শিকার বলে দেখা গেছে। আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া তাই ইঙ্গিত করে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক ড. সাত বীর সিং খালসা বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে যেসব কিশোর-কিশোরী যোগ-ধ্যান চর্চা করে তাদের উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও ঘুমের সমস্যা দূর হয়। তৈরি হয় আত্মসচেতনতা ও চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। চার্লস ড্রিউ ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, যে শিক্ষার্থীরা মেডিটেশন করেছে তাদের মধ্যে বিষণ্নতার উপসর্গগুলো অনেক কমে গেছে। এমনকি এদের কেউ কেউ ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের রোগীও ছিল।
কৈশোর বা তারুণ্যে অনেকের মধ্যেই একটা বেপরোয়া ভাব দেখা যায়। যার ফলে ধূমপান, মাদক, পর্ণ বা ভার্চুয়াল ভাইরাসের মতো নেশার তারা সহজ শিকার। মা-বাবার কথা না শোনা, শিক্ষককে অমান্য করা বা সমবয়সীদের সাথে রূঢ় আচরণ করা ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়। এই কৈশোরে মেডিটেশন চর্চা একদিকে ব্রেনের এমিগডালা অংশের তৎপরতা কমিয়ে তার ভয়, ক্রোধ এবং অস্থিরতা কমায়। অন্যদিকে মমতা, সহানুভূতি ও বিনয়ের আবেগকে করে তোলে শক্তিশালী।