রমজানে রোজাদারদের মেহমানদারির ঐতিহ্য ও গুরুত্ব
মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ :
রমজানে রোজাদারদের জন্য মেহমানদারি মুসলিম ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঐতিহাসিক ইবনুল আসির আত-তারিখ গ্রন্থে বলেন, আব্বাসীয় খলিফা নাসির লিদ্বিনিল্লাহ (মৃত্যু ৬২২ হি.) বাগদাদ নগরীতে কিছু বাড়ি তৈরির নির্দেশ দেন। সেখানে অসহায় ও দরিদ্রদের জন্য ইফতারি তৈরি করা হতো। দুরুদ দিয়াফা নামের এই বাড়িতে প্রতিদিন তাদের জন্য ছাগলের গোশত ও উন্নত রুটি রান্না হতো। এখানকার দায়িত্বশীলরা সাহায্যপ্রার্থী প্রত্যেককে পাত্রভর্তি গোশত ও এক কাইল (প্রায় ৪০ কেজি) রুটি দিত। প্রতিদিন সেখানে বিপুল পরিমাণ লোক ইফতার করত।
মূলত উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের রীতি ছিল, মানুষকে খাবার গ্রহণের জন্য তাদের কাছে আমন্ত্রণ জানানো। আর ফাতেমি সুলতানদের রীতি ছিল, মানুষের শ্রেণি ও প্রয়োজন অনুসারে তাদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা। এই তারা কায়রোর বিভিন্ন স্থানে রান্নাঘর স্থাপন করেছিল। আল-মাকরিজি তাঁর আলমাওয়ায়িজ গ্রন্থে বলেন, ফাতেমি খলিফা মুয়িজ লিদ্বিনিল্লাহর (মৃত্যু ৩৬৫ হি.) সময়ে ‘দারুল ফিতরাহ’ নামে একটি বাড়ি ছিল। তাতে সুস্বাদু এক ধরনের রুটি, হালুয়া, কেক, খেজুরসহ নানা ধরনের খাদ্য তৈরি করা হতো। রজব মাসের শুরু থেকে রমজান পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলত। মানুষের মধ্যে তাদের মর্যাদা অনুসারে খাবারের এসব পাত্র করে বিতরণ করা হতো।
আল-মাকরিজি তাঁর গ্রন্থে লিখেন, ফাতেমি ও আইউবি শাসনামলের সেনাপতি লুলু আল-হাজিব আল-আরমানি (মৃত্যু ৫৯৮ হি.) রমজানের আগে থেকেই জনসাধারণের জন্য ইফতার ও খাবারের আপ্যায়নের ব্যবস্থা নিতেন। প্রতিদিন তিনি খাবারভর্তি পাত্রসহ ১২ হাজার রুটি বিতরণ করতেন। রমজান মাস শুরু হলে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হতো। প্রতিদিন জোহরের পর থেকে এশার নামাজ পর্যন্ত এসব কার্যক্রম তিনি পরিচালনা করতেন। ২১ গজ দৈর্ঘ্যের তিনটি বাহনে করে খাবার বিতরণ করতেন। আর মানুষ দলে দলে এসে জমায়েত হতো। তিনি সবার মধ্যখানে চামচ ও ঘিয়ের পাত্র হাতে দাঁড়াতেন এবং রাখালের মতো সব কিছু পরিচালনা করতেন। আগত অসহায় গরিবদের সারি ঠিক করতেন এবং খাবার ও পানীয় এগিয়ে দিতেন। পুরুষ, নারী অতঃপর শিশুরা এসে খাবার গ্রহণ করত। বিশাল জমায়েত হলেও সেখানে ভিড় তৈরি হতো না। কারণ সবাই জানত যে একটু পরই তার অংশ আসছে। সবার পর ধনীদের পর্ব শুরু হতো। অনেক রাজা-বাদশাহও তার মতো এত বিশাল খাবার আয়োজনে সক্ষম ছিলেন না।
রমজানে দামেশকবাসীর মেহমানদারি নিয়ে বিশ্বপরিব্রাজক ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, রমজান মাস শুরু হলে মেহমান খুঁজে খাবারে অংশগ্রহণ করানো ছিল দামেশকবাসীর অন্যতম রীতি। তাঁদের কেউ রমজানের রাতে একাকী ইফতার করতেন না। গভর্নর, বিচারকসহ সমাজের গণ্যমান্যরাও অন্যদের ডেকে নিয়ে একসঙ্গে ইফতার করতেন। দরিদ্র ফকিররাও তাঁদের সঙ্গে অংশ নিতেন। বড় ব্যবসায়ীরাও সবাইকে নিয়ে ইফতার করতেন। অসহায় দরিদ্ররা তাঁদের বাড়ি বা মসজিদে গিয়ে প্রয়োজন অনুসারে খাবার নিয়ে আসতেন।
আল-মাকরিজি তাঁর আল-সুলুকলি মারিফাতি দুওয়ালিল মুলুক গ্রন্থে লিখেছেন, প্রসিদ্ধ মামলুক সুলতান আল-জাহির বারকুক (মৃত্যু ৮০১ হি.) তার শাসনামলে রমজানের প্রতিদিন ২৫টি গরু জবাই করতেন। এরপর তা রান্না করে কয়েক হাজার রুটিসহ মসজিদ, খানকা, সীমান্তবর্তী অঞ্চল, কারাগারসহ বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করতেন।