কয়লা চোরাকারবারিরা বেপরোয়া মাথায় হাত আমদানিকারকদের

দৈনিকসিলেট ডেস্ক :
‘ভাই আমার এখান দিয়ে ১০০ টনের মতো ভারতীয় কয়লা আসছে। এজন্য আপনাকে ফোন দিয়েছি। সিও (২৮ বিজিবির অধিনায়ক) স্যার কিংবা এসপি স্যারকে দয়া করে জানাবেন না।’ গত মঙ্গলবার রাত ২টায় এই প্রতিবেদকের কাছে তাহিরপুর সীমান্তের কলাগাঁও এলাকার এক শ্রমিক মোবাইল ফোনে কথাগুলো জানান।
কারা কয়লা আনে– এমন প্রশ্নে ওই শ্রমিক বলেন, ‘আমার নাম বললে বিপদে পড়ব। অনেকেই কয়লা আনে, তবে আজকে কলাগাঁওয়ের রব মিয়ার মাল আসবে।’
তাঁর কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে রাতেই রব মিয়াকে ফোন দেন এ প্রতিবেদক। রব মিয়া জানান, তিনি বুঙ্গার (চোরাই) কয়লা আনেন না। সেহরি খাওয়ার জন্য উঠেছেন। গত মঙ্গল ও বুধবার তাহিরপুর সীমান্তের তিন শুল্কবন্দরের চোরাই কয়লা ও ডিপো থেকে চুরি যাওয়া কয়লার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, এসব কাজে জড়িত অনেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
বুধবার আবারও রব মিয়াকে ফোন দেওয়া হলে জানালেন, ‘উড়েরগড় থেকে মহেষখলা পর্যন্ত অনেকেই চোরাই কয়লা আনে। কে কার নাম বলবে। আমাদের সঙ্গে সুনামগঞ্জের বড় বড় সাংবাদিকের যোগাযোগ আছে।’ তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক সমিতির বেতনভুক্ত এক কর্মচারী জানালেন, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসা কয়লাকেই বুঙ্গার কয়লা বা চোরাই কয়লা বলা হয়। ওপার থেকে এপারের জঙ্গলের ভেতর বা আশপাশের বাড়িতে প্রথম এনে রাখা হয়। এজন্য বস্তাপ্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা দিতে হয় ওপারের গারো-খাসিয়াদের। কমপক্ষে ৫০ টন একসঙ্গে জড়ো করে গভীর রাতে সুযোগ বুঝে সেগুলো এপারে আনা হয়। এসব কয়লার দাম লাখ লাখ টাকা। কয়লা ট্রলি দিয়ে প্রথম চারাগাঁও বেড়িবাঁধে রাখা হয়। পরে ছোট নৌকায় করে সমসার হাওর হয়ে বৈঠাখালি খালে এনে বড় নৌকায় তোলা হয়।
কয়লা আমদানিকারক সমিতির আরেক কর্মচারী জানালেন, সমিতির ২৬ জন সেন্ট্রি (পাহারাদার) আছেম যারা আমদানি করা কয়লা পাহারা দেয়। নৌকাপ্রতি এজন্য ৫০০ টাকা পায় তারা। এক সেন্ট্রি জানান– লামাকাটা, জঙ্গলবাড়ি ও কলাগাঁও এলাকা দিয়ে সীমান্তের কাঁটাতার কেটে পথ করা হয়েছে। ওই পথ দিয়ে রাতের আঁধারে কয়লার বস্তা বহুদিন ধরেই আনা হচ্ছে। এগুলো পাহারা দিতে তাদের বলা হয়নি।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শুল্কবন্দরগুলো হলো তাহিরপুরের বড়চোরা, চারাগাঁও ও বাগলি। এখানকার একজন বড় আমদানিকারক জানান– পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন মাসে চোরাই কয়লা নামে বেশি। এই মাসগুলোতে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার কয়লা চোরাই পথে ঢোকে। চোরাকারবারিদের কারণে ব্যবসা করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝেই আমদানি বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, এক টন কয়লা বৈধপথে এলে তা বিক্রি করতে হয় ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকায়। চোরাই কয়লা পাওয়া যায় ১৭-১৮ হাজার টাকায়। এমন অসম প্রতিযোগিতায় কীভাবে টিকবেন ব্যবসায়ীরা। শুল্ক স্টেশনে সাড়ে তিনশ আমদানিকারক ছিলেন, এখন সক্রিয় আছেন এক থেকে দেড়শ জন। তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক সমিতির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আবুল খায়ের বলেন, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অপকর্ম হচ্ছে। ট্যাক্স দিয়ে যারা ব্যবসা করছেন, তারা এখন অসহায়। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
তবে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হোসেন খান বলেন, লাউড়েরগড় থেকে বাগলি পুরো সীমান্ত পথেই অবৈধভাবে কয়লা আসে। তিনিও একজন আমদানিকারক। ব্যবসায়ীরা সবাই বিপদে। তাহিরপুর থানার ওসি ইফতেকার হোসেন বলেন, আমদানি কেন্দ্রগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় কিছু কাজ আছে বিজিবির এখতিয়ারে। সেগুলো আমরা দেখি না।
সুনামগঞ্জ বিজিবির পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, বিশাল সীমান্ত এলাকার পাঁচ কিলোমিটার পর পর বিজিবির ফাঁড়ি। ভারতীয় সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া আছে। গত বুধবারও নৌকাসহ প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকার কয়লা আটক করা হয়েছে। বিজিবির কেউ চোরাই কারবারিতে জড়িত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুত্র: সমকাল