কোরআনে আসমানি গ্রন্থ নিয়ে যা বলা হয়েছে
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা :
পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের ওপর অবতীর্ণ আসমানি গ্রন্থগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ছাড়া ব্যক্তির ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পূর্ববর্তী আসমানি গ্রন্থের বর্ণনা দিয়ে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসুল, তিনি যে কিতাব তাঁর রাসুলের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তাতে এবং যে কিতাব তিনি পূর্বে অবতীর্ণ করেছেন তাতে ঈমান আনো। এবং কেউ আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসুল এবং আখিরাতকে প্রত্যাখ্যান করলে সে তো ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৩৬)
আসমানি গ্রন্থগুলোর বৈশিষ্ট্য
পবিত্র কোরআনে পূর্ববর্তী আসমানি গ্রন্থগুলোর যেসব বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে তার কয়েকটি হলো :
১. হিদায়াতের ধারক-বাহক : আল্লাহ আসমানি কিতাবগুলো মানবজাতিকে সুপথ দেখাতে অবতীর্ণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। যা তার আগের পূর্ববর্তী কিতাবের সমর্থক। আর তিনি অবতীর্ণ করেছিলেন তাওরাত ও ইনজিল। ইতিপূর্বে মানবজাতির সৎপথ প্রদর্শনের জন্য।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩-৪)
আল্লামা সাদি (রহ.) বলেন, উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত, পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবগুলোকেও আল্লাহ সুপথের দিশারি হিসেবেই প্রেরণ করেছিলেন। যারা নিজ নিজ যুগের নবী ও কিতাবের অনুসরণ করেছে তারা সুপথ লাভ করেছে। (তাফসিরে সাদি, পৃষ্ঠা ১২১)
২. বিবাদ মীমাংসাকারী : আল্লাহ আসমানি কিতাবগুলো অবতীর্ণ করেছিলেন যেন মানবসমাজের বিবাদ দূর হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সব মানুষ ছিল একই উম্মত। অতঃপর আল্লাহ নবীদের সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন। মানুষ যে বিষয়ে মতভেদ করত তাদের মধ্যে সে বিষয়ে মীমাংসা করতে তিনি তাদের সঙ্গে সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৩)
৩. সবাই উপকৃত হতে পারে না : আল্লাহ আসমানি কিতাবকে হিদায়াতের উৎস বানালেও সবাই তা দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারীরাই তা দ্বারা উপকৃত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়, এটা দ্বারা তিনি তাদের শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ ইচ্ছায় অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। তিনি তাদের সরল পথে পরিচালিত করেন।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১৫-১৬)
৪. পরস্পরের সমর্থক : আল্লাহর অবতীর্ণ সব আসমানি গ্রন্থ পরস্পরের সমর্থক। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি তার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সমর্থক ও সংরক্ষকরূপে।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৮)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁকে পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে ও আল্লাহভীরুদের জন্য পথের নির্দেশ ও উপদেশরূপে ইনজিল তাদের পেছনে প্রেরণ করেছিলাম। তাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৬)
৫. গ্রন্থগুলো সংরক্ষিত নয় : আল্লাহ পবিত্র কোরআনকে সংরক্ষণ করলেও পূর্ববর্তী আসমানি গ্রন্থগুলো সংরক্ষিত নয়; বরং ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের গুরুরা তা বিকৃত করেছে। আল্লাহ তাদের নিন্দায় বলেছেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্য লাভের জন্য বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৭৯)
৬. এখন মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয় : মুহাম্মদ (সা.) আগমনের পর পূর্ববর্তী আসমানি গ্রন্থ রহিত হয়ে গেছে। তা এখন আর মানুষের মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। সুতরাং যারা তা অবলম্বন করে মুক্তি পেতে চায় তারা মিথ্যা আশা পোষণ করে থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের মধ্যে এমন কিছু মূর্খ লোক রয়েছে, যাদের মিথ্যা আশা ব্যতীত কিতাব সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। তারা শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৭৮)
৭. কিতাবধারীরা নবীজি (সা.)-এর আগমনে খুশি : প্রকৃতপক্ষে যারা পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবের প্রতি অনুগত, তারা মহানবী (সা.)-এর আগমনে খুশি হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছে আপনার প্রতি, যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা আনন্দিত হয়; কিন্তু কোনো কোনো দল তার কিছু অংশ অস্বীকার করে। বলুন! আমি আদিষ্ট হয়েছি আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তার সঙ্গে শরিক না করতে। তাঁর প্রতি আমি আহ্বান জানাই এবং তাঁর কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ৩৬)
৮. আছে কোরআনের কথা : পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বৈশিষ্ট্য ও কোরআনের বর্ণনা রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে অবশ্যই আছে এর (কোরআনের) কথা। বনি ইসরাঈলের পণ্ডিতরা এ বিষয়ে অবগত আছে—এটা কি তাদের জন্য নিদর্শন নয়?’ (সুরা : আশ-শুআরা, আয়াত : ১৯৬-১৯৭)
৯. আছে নবীজি (সা.)-এর বর্ণনা : পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবগুলোতে আল্লাহ মহানবী (সা.)-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে তাঁর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মি নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজিল, যা তাদের কাছে আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়, …সুতরাং যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনে তাকে সম্মান করে, তাঁকে সাহায্য করে এবং যে নুর তার সঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫৭)
১০. কিতাব বিকৃত করা মহাপাপ : আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব বিকৃত করা মহাপাপ। কেননা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপের শামিল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্যপ্রাপ্তির জন্য বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাদের হাত যা রচনা করেছে তার জন্য শাস্তি তাদের এবং যা তারা উপার্জন করে তার জন্য শাস্তি তাদের।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৭৯) আল্লাহ সবাইকে সত্য অনুসরণ করার তাওফিক দিন। আমিন