সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী, বিভিন্ন মহলের শ্রদ্ধা

দৈনিকসিলেটডটকম
আজ (৩০ এপ্রিল), সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২২ সালের এই দিনে ঢাকায় ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এদিকে আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সিলেটের বিভিন্ন সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সকালে মরহুমের কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
২০০৮ সালে নির্বাচনে জয় লাভের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ ১০ বছর তিনি বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় আর্থিক খাতে অসামান্য উন্নতি সাধন হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অবসর জীবনযাপন করলেও বই লেখার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা, তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের কর্ণধার অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজের দ্বিতীয় পুত্র আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরীও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেন।
তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে জেল খেটেছেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (সিএসপি) এ যোগদানের পর আবুল মাল আবদুল মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন।
তিনি পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপ-সচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন।
ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
অর্থনৈতিক কূটনীতিতে আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় তিনি একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
১৯৭২ সালে ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ফেরেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। দেশে আসার আগেই তার নিয়োগ হয়েছিল পরিকল্পনা সচিব হিসেবে। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সচিব ডেজিগনেট হিসেবে কাজ করেন তিন মাস। এই সময় বঙ্গবন্ধু তাকে দু’টি কাজ দেন। একটি ছিল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার পরিকল্পনা, অন্যটি ছিল জেলা প্রশাসনের গণতন্ত্রায়ন।
বলা হলো যে, মার্চ মাসের মাঝামাঝি আবুল মাল আবদুল মুহিতকে প্রতিবেদন ও সুপারিশ দিতে হবে। তিনি যথাসময়ে দুটি প্রতিবেদনই পেশ করেন। ১৯৭২ সালের স্বাধীনতা দিবসের বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু এই দুটি কার্যক্রম ঘোষণাও করলেন। কিন্তু তার জীবদ্দশায় সেগুলো বাস্তবায়ন হলো না। এছাড়া এই সময়ে যেসব বিদেশি মিশন ত্রাণ ও পুনর্বাসন নিয়ে আলোচনায় আসত তাদের সঙ্গে আলোচনায় আবুল মাল আবদুল মুহিতকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৭২ সালের এপ্রিলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ মিশনে চলে যান। আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশ মিশন হয়ে গেল বাংলাদেশ দূতাবাস। মুহিত সেখানে অর্থনৈতিক মিনিস্টার থাকেন দুই বছরের মতো। এই সময়ে ১৯৭২ সালে বেশ কিছুদিন তিনি ছিলেন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার।
১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্য হলে সেপ্টেম্বরে মুহিত হলেন বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের পক্ষে ভারত বাংলাদেশ শ্রীলংকা গ্রুপের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক, যেখানে ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন নির্বাহী পরিচালক।
১৯৭৩ সালে সেপ্টেম্বরে সপরিবারে ঢাকায় ফিরে আসেন। পরিবারের জন্য এই ছিল স্বাধীন বালাদেশে প্রথম পদার্পণ। ঢাকায় থাকেন জুন পর্যন্ত।
১৯৭৪ সালে মে মাসে ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়েই হুকুম পেলেন যে, তাকে ইসলামী মন্ত্রী সম্মেলনে যেতে হবে কুয়ালালামপুর এবং তারপর ঢাকায় যেতে হবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা ভ্রমণকালে। ভুট্টোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় তাকে বাংলাদেশ ডেলিগেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সময় তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়ে প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৪-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের মে পর্যন্ত মুহিত ছিলেন ম্যানিলায় অবস্থিত এডিবিতে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর।
১৯৭৭-১৯৮১ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮১-১৯৮২ মার্চ পর্যন্ত তিনি স্বাধীনভাবে নানা কনসালটেনসি করেন।
১৯৮২ সালের মার্চ মাসে জেনারেল এরশাদের স্বল্পমেয়াদী নির্দলীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৩ মে থেকে হলেন সবেতন মন্ত্রী। ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রীত্বে ছিলেন ২০ মাস। এর মধ্যে দুটি বাজেট পেশ করেছিলেন। মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করার সময় অনেক দ্বিধাবোধ ছিল তার। সামরিক সরকারের একজন হতে খুব আপত্তি ছিল। তাই অনেক রিজার্ভেশনসহ তখন মন্ত্রী হন।
১৯৮২-১৯৮৩ সালে অর্থমন্ত্রী মুহিতের প্রথম বাজেট পেশ করেন। তখন রাজস্ব আয় ছিল মোট ২৭১০ কোটি টাকা আর মোট সরকারি ব্যয় ছিল ৪৪১১ কোটি টাকা।
১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২-১৯৮৩ সালে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।
লেখক হিসেবেও আবুল মাল আবদুল মুহিত সমান পারদর্শী ছিলেন। প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার ৩৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে (বাপা) তিনি একজন পথিকৃত এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে সম্ভবত তার বইয়ের সংগ্রহ সবচেয়ে বেশি। তার সংগ্রহে প্রায় ৫০ হাজার বই রয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে তিনি ‘স্বাধীনতা পদক’ পান। স্ত্রী সৈয়দ সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং ছোট ছেলে সামির মুহিত শিক্ষকতা করেন।
শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন
মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য, সিলেটের কৃতি সন্তান, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সকালে নগরীর রায়নগরে পারিবারিক কবরস্থানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণকালে উপস্থিত ছিলেন, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, জেলা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আহমদ আল কবির, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ।
এদিকে সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়েছে। নগরীর রায়নগরে পারিবারিক কবরস্থানে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণকালে উপস্থিত ছিলেন-সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র-১ তৌফিক বক্স লিপন, কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ, কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান, কাউন্সিলর এস এম শওকত আমীন তৌহিদ, প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান প্রমুখ।
আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার কবর জিয়ারত করেন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। সকালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসময় আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করেন ও আবুল মাল আবদুল মুহিতের মাগফিরাত কামনা করে মহান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ড. আহমেদ আল-কবির, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলার আজাদুর রহমান আজাদ, জেলা যুবলীগের সভাপতি শামীম আহমদ ভিপি, সাধারণ সম্পাদক মো. শামীম আহমদ প্রমুখ।