সংবাদ পরিবেশনে ইসলামের ১০ নির্দেশনা
মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ :
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং সাংবাদিকদের অধিকার ও সম্মান সমুন্নত রাখতে প্রতিবছরের ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালিত হয়। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এই তারিখকে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গতকাল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে দিবসটির ৩০ বছর পূর্তি পালিত হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য : ‘Shaping a Future of Rights : Freedom of expression as a driver for all other human rights’ অর্থাৎ অধিকারের ভবিষ্যৎ গঠন : মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সব ধরনের মানবাধিকারের জন্য চালিকাশক্তি।
সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। আধুনিক যুগে মানুষের চিন্তা ও চেতনা বিকাশে প্রিন্ট, অনলাইন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রভাব প্রশ্নাতীত। সংবাদপত্র সাধারণ মানুষের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। তাই যেকোনো ঘটনার বিবরণ, বিশ্লেষণ ও বর্ণনায় সতর্কতা জরুরি। নিম্নে ইসলামের আলোকে সংবাদ সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো।
১. কল্যাণ প্রচারের মাধ্যম : সংবাদমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় ও নিপীড়নমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। অন্যদিকে কল্যাণের প্রত্যাশী হওয়া এবং অন্যায় কাজে বাধা দেওয়া একজন মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একদল হোক, যারা কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং ভালো কাজের আদেশ দেবে ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১০৪)
২. সমাজ ও রাষ্ট্রের পথপ্রদর্শক : সংবাদকর্মীর খবর সংগ্রহ ও পরিবেশন সমাজে কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে। হাদিসে সাধারণ মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনাকে দ্বিন আখ্যা দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘দ্বিন হলো অন্যের কল্যাণ কামনা করা। আমরা বললাম, কার জন্য? তিনি বলেন, আল্লাহ, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসুল এবং মুসলিম শাসক ও সাধারণ মুসলিমদের জন্য।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৫)
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘মুসলিম শাসকদের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ হলো, ভালো কাজে জনগণ তাদের আনুগত্য করবে ও সাহায্য করবে। কল্যাণমূলক কাজে তাদের নির্দেশনা মেনে চলবে এবং কোমল ভাষায় তাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেবে। (আল-মিনহাজ, পৃষ্ঠা : ৮৩/২)
৩. ইসলামে মতপ্রকাশের মাপকাঠি : ইসলাম মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। তবে কারো মতামত প্রকাশ যেন জনসাধারণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর না হয় তা নিশ্চিত করা জরুরি। একজন মুমিনের কাছে ঈমান সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। তাই মুমিনের চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা ও আচার-ব্যবহার কেমন হবে তা ইসলামী শরিয়তে বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচার ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও সীমালংঘন থেকে নিষেধ করেন, তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কোরো।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৯০)
৪. কোরআনের বর্ণনায় সাংবাদিকতা : পবিত্র কোরআনের সুরা নামলে ২০ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে সুলাইমান (আ.)-এর সঙ্গে হুদহুদ পাখির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তার বর্ণনার ধরন থেকে সংবাদের নতুনত্ব, দলিল ও প্রমাণ, সমস্যা ও এর সম্ভাব্য সমাধান এবং আলোচিত ব্যক্তিদের গুণাবলির পাশাপাশি সমালোচনাও রয়েছে। এতে সংবাদ বর্ণনার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘(অনেক খোঁজাখুঁজির পর) হুদহুদ এসে বলল, আমি যা জেনেছি আপনি তা জানেন না, আমি সাবা থেকে আপনার জন্য সুনিশ্চিত খবর নিয়ে এসেছি’। আমি এক নারীকে তাদের ওপর রাজত্ব করতে দেখেছি, তাকে সব কিছু দেওয়া হয়েছে এবং তার এক বিশাল সিংহাসন রয়েছে…।’ (সুরা নামল, আয়াত : ২২-২৩)
৫. সুস্থ সাংবাদিকতা সওয়াবের কাজ : গণমানুষের কল্যাণে কাজ করাই সুস্থ সাংবাদিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর ভালো কথার মাধ্যমে মানুষের উপকার করা সওয়াবের কাজ। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে এবং ভালো কাজ করে তাদের আপ্যায়নের জন্য আছে ফেরদাউসের বাগান।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত : ১০৭)
হাদিসে ভালো কথাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাধ্যম বলা হয়েছে। আদি বিন হাতিম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা এক টুকরা খেজুরের বিনিময়ে হলেও আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা কোরো। খেজুরের টুকরা না পেলে তাহলে ভালো কথার মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা কোরো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৫৯)
৬. খবরের যাচাই-বাছাই : সাধারণত অসত্য সংবাদ প্রচার নৈতিকতাপরিপন্থী কাজ। কারো ব্যাপারে কোনো বিষয় জানলে তা নিশ্চিত হওয়া ছাড়াই বর্ণনা করা অনুচিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের কাছে কোনো পাপাচারী ব্যক্তি সংবাদ নিয়ে এলে তোমরা তা যাচাই-বাছাই কোরো, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি না করো এবং পরবর্তী সময়ে যেন নিজেদের কাজের জন্য তোমরা অনুতপ্ত না হও।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ৬)
৭. মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন গুনাহ : যেকোনো বিষয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া গুরুতর পাপ। আর মানুষের কাছে সত্যকে মিথ্যা বলে প্রচার করা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে বেড়ানো আরো ভয়াবহ। আবু বাকরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদিন আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বসা ছিলাম। তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় পাপ সম্পর্কে জানাব না?’ রাসুল (সা.) কথাটি তিনবার বলেছেন। (সাহাবিরা সম্মতিসূচক কথা বলার পর) তিনি বলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া বা মিথ্যা কথা বলা।’ রাসুল (সা.) কথাগুলো বলার সময় হেলান দেওয়া ছিলেন। অতঃপর সোজা হয়ে বসে তা অনেকবার বলতে থাকেন। আমরা মনে মনে বলছিলাম, আহ, তিনি যদি চুপ হতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫১০)
৮. সংবাদ পরিবেশনে ব্যক্তির দায় : মানুষের মুখের কথা বা হাতের লেখা যেমন পুণ্য অর্জনের মাধ্যম হতে পারে তেমনি পাপের কারণও হতে পারে। তাই যেকোনো সংবাদ বর্ণনার ক্ষেত্রে সততা জরুরি। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ কোরো না; কান, চোখ ও অন্তর সব কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৬)
মানুষ মুখে যা বলে ফেরেশতারা তা লিখে রাখেন। তাই সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে এর পুরো দায়ভার ব্যক্তির ওপর বর্তাবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার (লিপিবদ্ধ করার) জন্য তৎপর প্রহরী তার কাছেই রয়েছে।’ (সুরা কাফ, আয়াত : ১৮)
পরকালে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার অন্যায্য কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। কোরআনের বর্ণনা অনুসারে কিয়ামতের দিন মানুষের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তার হাত ও পা কথা বলতে থাকবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আজ তাদের মুখগুলো মোহর করে দেব, আমার সঙ্গে তাদের হাতগুলো কথা বলবে এবং তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের পাগুলো সাক্ষ্য দেবে।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত : ৬৬)
৯. পাপ কাজ প্রসার নয় : বহু সংবাদমাধ্যমকে সমাজে অশ্লীলতা ও পাপাচার প্রসারের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা প্রচার করতে চায় তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তি রয়েছে, মূলত আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং তোমরা জানো না।’ (সুরা নুর, আয়াত : ১৯)
১০. মন্দ কথা আল্লাহর ক্রোধ বাড়ায় : ভালো কথার মাধ্যম মানুষ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে। তেমনি মিথ্যা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে মানুষের ওপর আল্লাহর ক্রোধ পড়তে পারে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ অসচেতনভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টিদায়ক কোনো কথা বলে। তবে এর কারণে আল্লাহ তার মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেন। আবার মানুষ অসচেতনভাবে আল্লাহর অসন্তুষ্টিদায়ক কোনো কথা বলে ফেলে। ফলে সে কথার কারণে সে জাহান্নামে গিয়ে পড়ে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪৭৮)