হালাল উপার্জন ফরজ ইবাদতের সমান
মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান
মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল সামাজিক জীব। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে। ইহকালীন জীবনে মানুষকে জীবিকা নির্বাহের জন্য বেছে নিতে হয় বিভিন্ন কর্ম ও পেশা। বিনিময় করতে হয় শ্রম। পৃথিবীতে যারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তাদের সবাই নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমেই তা লাভ করেছে। বলা হয়ে থাকে, ‘পরিশ্রম সাফল্যের প্রসূতি।’ অন্যদিকে শ্রমবিমুখতা জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বিরাট অন্তরায়। শ্রমবিহীন ব্যক্তি দেশ ও জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। আল্লাহর প্রেরিত জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের মধ্যে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমাজজীবনের নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তিশ্রম বা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে ইসলামে শ্রম ও কর্মকে ইবাদত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাজজীবনে আল্লাহর বিধান ও রাসুল (সা.)-এর প্রদর্শিত পন্থায় শারীরিক পরিশ্রম করাকে ইবাদত হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর সবার জন্যই তাদের আমল অনুসারে মর্যাদা রয়েছে। আর আল্লাহ যেন তাদেরকে তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দিতে পারেন। আর তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না।’ (সুরা : আহকাফ, আয়াত : ১৯)
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) শ্রমকে ভালোবাসতেন। যিনি সব নবীর সরদার হয়েও নিজ হাতে জুতা মেরামত করেছেন, কাপড়ে তালি লাগিয়েছেন, ছোটবেলায় মাঠে মেষ চরিয়েছেন। নবীজি (সা.) ব্যবসা পরিচালনাও করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে সাহাবাদের সঙ্গে নিজে পরিখা খনন করেছেন। বাড়িতে আগত মুসাফির কর্তৃক বিছানা অপবিত্র করে রেখে যাওয়ায় নিজ হাতে তিনি তা ধৌত করে মানবতা ও শ্রমের মর্যাদাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পরিশ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, কিছু গুনাহ এমন আছে, যা হালাল রিজিক উপার্জনের চিন্তা ছাড়া মাফ হয় না। (তাবারানি, মুজামুল আওসআত, হাদিস : ১০২)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, অন্যান্য ফরজ কাজ আদায়ের সঙ্গে হালাল রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা গ্রহণ করাও একটি ফরজ। (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান)
ইসলামে কোনো পেশাকে ছোট করা হয়নি। পৃথিবীতে যে যত পরিশ্রমী সে তত বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ পরিশ্রমের কারণে প্রতিভার বিকাশ ঘটে। পরিশ্রমী ব্যক্তিরাই নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কারো পক্ষে এক বোঝা লাকড়ি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নেওয়া কারো কাছে চাওয়ার চেয়ে উত্তম। কেউ দিতেও পারে, না-ও দিতে পারে।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৭৪)
প্রিয় নবীজি (সা.) উম্মতদের দরিদ্রতা, বেকারত্ব, অলসতা ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্ত থেকে মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ওমর (রা.) বলেন, তোমাদের কেউ রিজিকের অন্বেষণ থেকে যেন হাত গুটিয়ে বসে না থাকে। কেননা আসমান থেকে সোনা-রুপা অবতীর্ণ হয় না। মিকদাম (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, নিজ শ্রমে উপার্জিত জীবিকার চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৭২)
আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রেরিত পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলের জীবিকা নির্বাহের পদ্ধতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তারা প্রত্যেকেই শ্রম ও শ্রমভিত্তিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আদম (আ.) কৃষিকাজ করেছেন, নুহ (আ.) কাঠমিস্ত্রির কাজ করেছেন, ইদ্রিস (আ.) কাপড় সেলাই করে পোশাক তৈরি করেছেন, ইবরাহিম (আ.) ও লুৎ (আ.) কৃষিকাজ করতেন, সালেহ (আ.) ছিলেন ব্যবসায়ী এবং দাউদ (আ.) বর্ম তৈরি করেছেন; মুসা ও শুয়াইব (আ.) ভেড়া চরাতেন এবং আমাদের নবী (সা.) ব্যবসায়ের কাজ করেছিলেন, তাই তিনি তাঁর চাচার ব্যবসা পরিচালনা করতে সিরিয়ায় গিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি দাউদকে আমার তরফ থেকে অনুগ্রহ প্রদান করেছিলাম। হে পর্বতমালা, তোমরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং হে পক্ষীকুল, তোমরাও। আর লৌহকে তার জন্য নম্র করেছিলাম। (হে দাউদ) প্রশস্ত বর্ম তৈরি করো, কড়া যথাযথভাবে সংযুক্ত করো এবং সৎকর্ম সম্পাদন করো। তোমরা যা কিছু করো, আমি তা প্রত্যক্ষ করি।’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ১০-১১)
ইসলামে কর্মবিমুখতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা এটা মানবতার জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে। আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের ইবাদত-বন্দেগি করার পরপরই কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন সালাত সমাপ্ত হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা : জুমা, আয়াত : ১০)
প্রিয় নবীজি (সা.)-এর সাহাবারাও নিজেদের কাজকর্ম নিজেরাই করতেন। কোনো শ্রমকে তারা ছোট করে দেখেননি। হাদিসে আছে, আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরা নিজেদের কাজ-কর্ম নিজেরা করতেন। ফলে তাঁদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হতো। সে জন্য তাঁদের বলা হলো, যদি তোমরা গোসল করে নাও (তবে ভালো হয়)। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৭১)
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ