ঝরে যাওয়া এক শিল্পীর গল্প
শিমুল আহমেদ
ভারতের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল জি বাংলার সংগীতবিষয়ক প্রতিযোগিতা ‘সারেগামাপা’র প্রতিযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয় মাইনুল আহসান নোবেলের। তার কণ্ঠে আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’ ও জেমসের ‘বাংলাদেশ’ গানটি দিয়েই শেষ হয় সেবারের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা।ওই সময় হাজার হাজার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ‘সারেগামাপা ২০১৯’র দ্বিতীয় রানারআপ হন গোপালগঞ্জের ছেলে নোবেল।
তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় ছেলে তিনি। জন্ম গোপালগঞ্জে হলেও তার শৈশব কেটেছে গোপালগঞ্জ, খুলনা ও ঢাকায়। গান পাগল এই ছেলের খুব একটা মন ছিল না পড়াশোনায়। প্রায় সময়ই তার কণ্ঠে থাকত কোনো না কোনো শিল্পীর গান। তার গিটারের হাতেখড়ি হয় বন্ধুদের কাছে।
২০১৬ সালে নোবেল একটি ব্যান্ডদলও গড়ে তোলেন। এরপর থেকেই গানের সঙ্গে তার চলাফেরা। নোবেলের গায়কিতে মুগ্ধ ছিলেন সবাই। তখনো নোবেল নাম লেখাননি ‘সারেগামাপা’তে। একটা সময় তার পরিবারের লোকজনও তাকে গান চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেন। নাম লেখান জি বাংলার প্রতিযোগিতায়। এভাবেই তার এগিয়ে চলা।
নোবেলের দারাজ কণ্ঠ অল্প ক’দিনেই দুই বাংলাতে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু সেই মুগ্ধতা ধরে রাখতে পারেননি তিনি। গানের পাশাপাশি জড়িয়ে যান বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডে। প্রতিযোগিতার মঞ্চে তাকে নিয়ে প্রথম বিতর্ক- স্টেজে গাইতে গিয়ে মূল গানের গীতিকার, সুরকারদের নাম না বলা। এ নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়েন নব্বই দশকের জনপ্রিয় গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদ। অবশ্য পরে বিষয়টি নিয়ে ক্ষমাও চান নোবেল। এরপর থেকেই যেন নোবল আর বিতর্ক এক সুতোয় গাঁথা হয়ে যায়।
কিছুদিন না যেতেই নোবেল দাবি তোলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বদলানোর। ঘটনা ২০১৯ সালের। বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে। সে সময়ও নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চান তিনি।
তবে এর কিছুদিন যেতে না যেতেই নোবেল বয়কটের আহ্বান জানান রবীন্দ্র সাহিত্যচর্চার। আর সে কারণে রবীন্দ্রভক্তদের মনে থেকে পুরোপুরি উঠে যায় এই গায়কের নাম। তখনই তিনি প্রশ্ন তোলেন তার গানের বিচারকার্য নিয়ে। টেনে আনেন ‘সারেগামাপা’র প্রতিযোগিতার বিষয়টিও। অনুষ্ঠানের এক বিচারকের প্রসঙ্গ টেনে নোবেল জানান, তার গান বিচার করার ক্ষমতা ওই বিচারকের নেই।
সে কারণে জি বাংলা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বেশ কিছুদিনের জন্য ‘নোবেল ম্যান’কে বয়কট করে। শুরু থেকেই এভাবে নতুন নতুন বিতর্কের সঙ্গে নিজের নাম জড়াতে থাকেন নোবেল। আবার পরবর্তী সময়ে বিষয়টির জন্য অনুতপ্তও হন তিনি। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়ে যায়!
নোবেলের ওপর বাংলা গানের শ্রোতাদের একটি বড় ক্ষোভ তৈরি হয়, যখন তিনি জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা জেমসকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলেন। ঘটনাটি ছিল ২০২১ সালে। সে সময় শ্রোতাদের পাশাপাশি দেশের শিল্পীরাও তাকে ‘বেয়াদপ’ বলে আখ্যা দেয়।
তখন জনপ্রিয় সুরকার ইথুন বাবুকে নিয়েও আপত্তিকর মন্তব্য করে তিনি। বিষয়টি নিয়ে নোবেল চুপ না থাকলেও নিশ্চুপ ছিলেন নগরবাউল’খ্যাত তারকা জেমস। সে সময় নোবেলের একাধিক বিতর্কিত ইস্যুতে তার সঙ্গে ২২টি গানের চুক্তি বাতিল করে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেক। এভাবে ক্রমশই শিল্পীরা ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো নোবেলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
নোবেল থেকে সংগীতাঙ্গনের শিল্পীরা যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন, সে সময় তার পাশে দাঁড়ান আসিফ আকবর। কিন্তু সে মুখও রাখেনি নোবেল। তার সঙ্গেও করেছেন চরম বেয়াদবি।
এরপর আসে তার ব্যক্তিজীবন। মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে স্ত্রী সালসাবিল মাহমুদকে নিয়েও বহু আজেবাজে কথা বলতে শুরু করেন বিয়ের দু’বছরের মাথায়। সে সময় সালসাবিল জানান, মাদকের কারণে অনেকটাই অসুস্থ তিনি। এই নোবেল আর সেই নোবেল নেই।
একাধিক মেয়ের সঙ্গে নোবেলের অবৈধ সম্পর্ক আছে- এমনটাও শোনা যায় তার মুখে। বিষয়টি নিয়ে তখন সংবাদের শিরোনামও হয় নোবেল। এসব ‘অবৈধ সম্পর্ক’র বিষয়ে কথাও বলেন সালসাবিল। এমনটা আর আগামীতে হবে না- এই মর্মে সেবার স্ত্রীর কাছে ক্ষমা পান নোবেল।
তাকে সুস্থ করার জন্য ভর্তি করা হয় একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। সেখানে বেশ কিছুদিন ভর্তি থাকলেও, নেশার জগত ছাড়তে পারেনি তিনি। তখন প্রকাশ্যে আসে, নোবেল-সালসাবিলের বিচ্ছেদের বিষয়টি। সে সময় এই গায়ক তার স্ত্রীর কাছে একটি সুযোগ চেয়ে নেন আর সেই সুযোগটিও দেন সালসাবিল।
কিন্তু আদতে কোনো লাভ হয়নি। নেশার ভুবন থেকে ফেরানো যায়নি নোবেলম্যানকে। ক’দিন আগেই প্রকাশ্যে আসে, স্টেজে গান গাইতে গিয়ে তার মাতলামির খবর। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সংগীতের অনেক তারকা শিল্পীরা। তাদের কথায়, ‘এমন নামধারী শিল্পীরাই সংগীতের বদনাম করছে!’
স্টেজে নোবেলের মাতলামির খবর প্রকাশ্যে আসার পর তার স্ত্রী সালসাবিল মাহমুদ জানান বহু অজানা তথ্য। তার কথায়, নোবেল নেশার জগতে হারিয়ে গেছে। সংগীতের এই মানুষটি আর সেই নোবেল নেই। তার মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে অনেক ক্ষমতাসীন লোকজন জড়িত আছে। শুধু তাই নয়, মাদকের সব শাখাতেই তার বিচরণ। আর মাদকাসক্ত নোবেল প্রায়ই তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতেন। যে কারণে সম্প্রতি নোবেলকে তালাকের নোটিশও পাঠিয়েছেন তিনি।
সালসাবিল মাহমুদ জানান, তার চোখের সামনেই একজন সুরেলা কণ্ঠের গায়কের মৃত্যু হয়েছে। এখন নোবেল কারও কথাই শোনে না। সে নিজের ইচ্ছেতেই চলে। আর এ কারণেই তার আজকের এমন পতন।সূত্র:আমাদেরসময়