আপনি যদি সুখি হতে চান…
ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী
আপনি যদি সুখি হতে চান তাহলে পরিবারকে নিয়ে একসঙ্গে থাকুন,যে শক্তির মাধ্যমে আপনি পৃথিবী না ,এই পৃথিবীর বাইরের সকলকেও জয় করতে পারবেন।
‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের স্ত্রীদের থেকে সন্তান-সন্ততি ও নাতি-পুতি দান করেছেন, তোমাদের আরো দিয়েছেন উত্তম রিজিক। এর পরও তারা কি মিথ্যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করবে?’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৭২)।আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘আর তোমরা তাদের সঙ্গে সুন্দরভাবে বসবাস করো। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৯)
“পারিবারিক বন্ধন হলো পরিবারের সকল সদস্যদের মধ্যে তৈরি হওয়া আবেগীয় সম্পর্ক। পারস্পরিক বিশ্বাস, স্নেহ, ভালোবাসা, সম্মান, আস্থা ইত্যাদি পারিবারিক বন্ধনের ভিত্তি। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না হলে পরিবারের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে, যার ফলে সমাজ ব্যবস্থা দুর্বল হয় এবং তৈরি হয় সামাজিক অস্থিরতা।সুষ্ঠু পারিবারিক জীবনই সমাজ-রাষ্ট্রের মূলভিত্তি।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা আছে।বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতনামা নায়িকা ও সাবেক সংসদ সদস্য কবরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মারা যাওয়ার পর তার একটি সাক্ষাৎকারের একটি অংশ ভাইরাল হয়। তিনি এরকম বলেছিলেন যে, ‘জীবনে ভালো একজন বন্ধু পেলাম না, ভালো একজন স্বামী পেলাম না, সন্তানরাও যে যার মতো! কারো সাথে বসে এক কাপ চা খাবো, মনের কথা খুলে বলব, তা পেলাম না।’ খ্যাতনামা কলামিস্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের লাশ নিজের বাসা থেকে দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করা হয়। বাসায় তিনি ছিলেন একা। স্ত্রী ও কন্যা আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। অসুস্থ ও মৃত্যুর সময় কেউ ছিল না পাশে এবং মারা যাওয়ার বিষয়টি কেউ কিছু জানেনি। এক করোনা রোগী সুইসাইড নোট লিখে মুগদা হাসপাতাল থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি লিখে গেছেন, নিজের একাকিত্বের কথা। টাকা ছিল কিন্তু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু ছিল না কাছে। পরিবার ও আত্মীয়দের সবাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশে! একাকীত্ব সহ্য করতে পারেন নি।
প্রত্যেকটি বিষয়ই হৃদয়স্পর্শী, যা সমাজ ও পরিবারকে কঠোরভাবে আঘাত করেছে।কিন্তু কেন একাকিত্ব? কেবলই ভালো থাকার আশা নাকি সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করার একটি প্রক্রিয়া? প্রতিনিয়ত ভালো ও বড় হওয়ার আশায় মানুষ পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করছে। কিন্তু আমরা অর্থনৈতিকভাবে বড় হলেও হারিয়ে ফেলছি মানবিকতার জায়গাটুকু। ফলে তৈরি হচ্ছে বন্ধন ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া।একটু যাচাই বাছাই করলে দেখা যাবে, এর সাথে কেবল সময়ই জড়িত নয়।আমরা আমাদের প্রজন্মকে মানবিকতার শিক্ষাটুকু দিতে ব্যর্থ হচ্ছি।
যে উদ্দেশ্যে পরিবার গঠিত হয়ে থাকে তার প্রকৃত উদ্দেশ্যে তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। কেবলমাত্র ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছি। সবাই তার সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার এখন আবার রাজনীতিক বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-রাজনীতিক হওয়ার পরও যে ভালো মানুষ হতে হবে বা সামাজিকভাবে বসবাস করতে হবে, এ শিক্ষা দিচ্ছি না আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে। পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গাটা আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করছি অনেক ক্ষেত্রেই।অর্থ রোজগারের সাথে মানবিকতা যোগ না হওয়ার কারণে সব বিনষ্ট হচ্ছে। সমাজকর্মীরাও রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি সামাজিকভাবে জেগে থাকা মানুষগুলো আজ সমাজের চোখে অকর্মণ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। একসময় মানুষের উপকার করা রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নিতেন রাজনৈতিক নেতারা। মানুষের উপকার করাই ছিলো তাদের প্রধান ব্রত। কালক্রমে চেয়ার দখল, অর্থ উপার্জন এবং শাসকের ভূমিকায় পরিণত হয়েছে রাজনীতি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যে সব সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত ছিল তা অদৃশ্য কারনে হারিয়ে গেছে। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যে অর্জন করতে পেরেছিলাম সেটাও আজ মলিন। শিক্ষা কেবলমাত্র সার্টিফিকেটে আটকে যাচ্ছে।
আধুনিক সময়ে মানুষ যত বেশি উচ্চাশাকাঙ্ক্ষী হচ্ছে তত তার আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবও বাড়ছে৷সংযুক্ত পরিবার ভেঙে টুকরো হতে হতে নিউক্লিয়াস পরিবারে এসে থেমেছে৷ সফল হওয়ার খেলায় মেতে মানুষ ভুলে যায়, আসলে সে কতটা একা হয়ে যাচ্ছে৷ এক সময় দেখা যায় তার পাশে আর কেউ নেই।বর্তমানে পরিবারের বন্ধন ব্যাপকহারে ভেঙ্গে যাচ্ছে। এই কারণেই আমাদের সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে চলেছে দিন দিন। একদিকে যেমন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, তেমনি স্বামী -স্ত্রী তাদের মা বাবাকে ছেড়ে আলাদা বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করছেন। আবার এখন তো দেখা যাচ্ছে পরিবারে স্বামী-স্ত্রীও মিলেমিশে থাকতে পারছেন না৷
আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি যে, জীবনে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে হলে পরিবারের সুনিবিড় ও দৃঢ় বন্ধন থাকা আবশ্যক।পারিবারিক বন্ধন মানুষের জীবনকে সুন্দর এবং অর্থবহ করে তোলে।বয়স যত বাড়ে আমাদের তত বেশি করে অসহায়তা গ্রাস করে৷ বয়স্করা তাই পরিবারের আপনজনদের সব সময় কাছে পেতে চান এবং সবাই মিলেমিশে থাকলে তাদের মনে একটা গভীর আনন্দ অনুভব করেন৷ এতে নিরাপত্তার অভাব বোধ কমে যায়৷ পারিবারিক একাত্মতা দেয় সুখী জীবন৷ তাই আমাদের সকলের উচিত মা-বাবা ,আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে মিলেমিশে থাকা৷ পারিবারিক সম্পর্কগুলো আমরা যেন কোনও ভাবেই গুরুত্বহীন মনে না করি। পরিবারে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় কিন্তু পারস্পরিক বোঝাপড়া যদি অক্ষুন্ন থাকে, তবে জীবন চলার পথে কোনও চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারবে না।হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আমি আমার পরিবারের কাছে উত্তম।”[সুনানে তিরমিযি (৩৮৯৫),।”
(লেখক কর্তৃক সংকলিত )