কিয়ামতের দিন মানুষ যেভাবে পুলসিরাত পার হবে
মুফতি ইবরাহিম সুলতান
পুলসিরাত শব্দটি ফারসি ও আরবি ভাষার সমন্বয়ে গঠিত। ‘পুল’ শব্দটি ফারসি। এর অর্থ সেতু। ‘সিরাত’ আরবি শব্দ।
এর অর্থ রাস্তা বা পথ। তবে ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ পারলৌকিক সেতু বা পুল। এটি জাহান্নামের ওপর নির্মিত একটি বিশেষ পুল, যা অতিক্রম করে মুমিনদের জান্নাতে যেতে হবে; আর জাহান্নামবাসী পুলসিরাত অতিক্রম করার সময় নিচে পড়ে যাবে। দীর্ঘ হাদিসের এক অংশে সাহাবিরা আল্লাহর রাসুলকে জিজ্ঞেস করলেন, সে পুলটি (পুলসিরাত) কেমন হবে হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বলেন, দুর্গম পিচ্ছিল স্থান।
এর ওপর আংটা ও হুঁক থাকবে, শক্ত চওড়া উল্টো কাঁটাবিশিষ্ট হবে, যা নাজদ দেশের সাদান বৃক্ষের কাঁটার মতো হবে। সে পুলের ওপর দিয়ে ঈমানদারগণের কেউ পার হয়ে যাবে চোখের পলকের মতো, কেউ বিদ্যুতের মতো, কেউ বাতাসের মতো আবার কেউ দ্রুতগামী ঘোড়া ও সাওয়ারের মতো। (বুখারি, হাদিস: ৭৪৩৯)
পুলসিরাত সম্পর্কে আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘পুলসিরাত চুলের চেয়েও অনেক চিকন এবং তরবারির চেয়েও অধিকতর ধারালো হবে।’
অন্য বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘পুলসিরাত হবে ক্ষুরের চেয়েও অনেক ধারালো।
’ (মুসলিম, হাদিস : ১৮৩, মুস্তাদরাকে হাকেম হাদিস : ৮৭৩৯)
ভয়াবহ এই পুলটি প্রতিটি মানুষকে অতিক্রম করতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে প্রত্যেকেই তার আপন জায়গায় পৌঁছবে।
পুলসিরাতে মুমিন ও মুনাফিকদের অবস্থা
পুলসিরাতে মুনাফিকদের অবস্থা হবে খুবই ভয়াবহ। কারণ পুলসিরাত হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন। আল্লাহর পক্ষ থেকে নুর (আলো) ছাড়া তা পার হওয়া কখনো সম্ভব নয়।
এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, (কিয়ামতের দিন) মুনাফিক হোক বা মুমিন হোক প্রত্যেক মানুষকেই নুর প্রদান করা হবে। তারপর তারা এর অনুসরণ করবে। জাহান্নামের পুলের ওপর থাকবে কাঁটাযুক্ত লৌহ শলাকা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাকে সেগুলো পাকড়াও করবে। অতঃপর মুনাফিকদের নুর নিভে যাবে। আর মুমিনগণ মুক্তি পাবেন…।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯১, মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৪৭৬৩)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মানুষ যখন অন্ধকারে থাকবে, আল্লাহ তখন (তাদের কাছে) নুর প্রেরণ করবেন। মুমিনরা নুর দেখে সেদিকে ধাবিত হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এই নুর-ই হবে তাদের জান্নাতে যাওয়ার দলিল।’ (ফাতহুল কাদির ৫/২০৫)
এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে আবিল আল হানাফি (রহ.) বলেন, ‘এই অন্ধকার স্থানে মুনাফিকরা মুমিনদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে। মুমিনরা সামনে অগ্রসর হবে; কিন্তু মুনাফিকরা তাদের থেকে পেছনে পড়ে থাকবে। তাদের মাঝে প্রাচীর দিয়ে মুমিনদের থেকে পৃথক করা হবে এবং মুমিনদের নিকটে আসতে বাধা দেওয়া হবে।’ যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন মুনাফিক পুরুষ ও নারীরা ঈমানদারগণকে বলবে, তোমরা একটু থামো, তোমাদের থেকে কিছু আলো নিয়ে নিই। তখন বলা হবে, পেছনে ফিরে যাও! সেখানে আলোর সন্ধান করো। অতঃপর উভয়ের মধ্যে প্রাচীর দাঁড় করানো হবে। যাতে একটা দরজা থাকবে। যার ভেতরের দিকে থাকবে রহমত ও বাইরের দিকে থাকবে শাস্তি।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত : ১৩, শারহুল আকিদা আত-তাহাবিইয়াহ, পৃষ্ঠা ৪১৪)
ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, তারা (মুনাফিকরা) যখন পুলসিরাতের মাঝামাঝিতে চলে আসবে নেফাকির ঝোড়ো বাতাস তাদের নুর উড়িয়ে নিয়ে যাবে এবং তাদের হাতে থাকা প্রদীপ নিভিয়ে দেবে। ফলে তারা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং পুলসিরাত পার হতে সক্ষম হবে না। এ অবস্থায় ঈমানদার ও তাদের মাঝে এক দরজাবিশিষ্ট একটি প্রাচীর দাঁড় করানো হবে।’ (মাদারিজুস সালেকিন, ১/৩৬৪)
ঈমান ও আমলের তারতম্য অনুযায়ী পুলসিরাত অতিক্রমকারী
১. নিরাপদে অতিক্রমকারী
যারা পূর্ণ ঈমানদার, সৎকর্মশীল, কবিরা গুনাহ থেকে মুক্ত, মৃত্যুর আগে খালেস তাওবাকারী—তারা নিরাপদে আগুনের তাপ ও স্পর্শ অনুভব না করেই পুলসিরাত পার হয়ে যাবেন। দুনিয়াতে নেক আমলে যিনি যত অগ্রগামী ছিলেন, পুলসিরাতে তার গতিও হবে অনুরূপ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আগুনের (পুলসিরাতের) ওপর দিয়ে লোকজন অতিক্রম করবে। তারা তাদের আমল অনুপাতে অতিক্রম করতে থাকবে। তাদের প্রথম দল বিদ্যুৎ চমকানোর মতো দ্রুত বেগে পার হয়ে যাবে। পরবর্তী দলটি বাতাসের বেগে, তারপর দ্রুতগামী ঘোড়ার বেগে, তারপর উষ্ট্রারোহীর বেগে, তারপর মানুষের দৌড়ের গতিতে, তারপর হেঁটে চলার গতিতে অতিক্রম করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩১৫৯)
২. ক্ষতবিক্ষত হয়ে অক্রিমকারী
মুসলিমদের মধ্যে যারা পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিল, তারা তাদের পাপের পরিমাণ অনুযায়ী পুলসিরাতে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুলসিরাত জাহান্নামের দুই তীরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। তাতে থাকবে সাদান বৃক্ষের কাঁটাসদৃশ কাঁটাসমূহ। মানুষকে তার ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে বলা হবে। তাদের কতক ব্যক্তি কাঁটার আঁচড় খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হবে, তারপর নাজাত পাবে…।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১১০৮১)
এই দলের লোকদের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম বলেন, ‘এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবে তারাই, যারা পাপকাজ করেছে এবং বিভিন্ন ধরনের ভুল-ত্রুটি করেছে। পুলসিরাতের আঁকড়া তাদের আক্রমণ করবে, ফলে তাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হবে। অতঃপর তারা তাদের পার্থিব জীবনের প্রেরিত নেক আমলের কারণে আল্লাহর দয়ায় মুক্তি পেয়ে যাবে।’ (আল মাওসুআতুল আকাদিয়াহ ৫/১৪)
৩. জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত
পুলসিরাত অতিক্রমকারীদের মাঝে বড় দলটি তাদের পাপের কারণে আটকে যাবে এবং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুলসিরাত জাহান্নামের দুই তীরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। মানুষকে তার ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে বলা হবে।…কতক ব্যক্তি সেখানে আটকে যাবে এবং মুখ থুবড়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১১০৮১)
পুলসিরাত অতিক্রমকালে কাফিরদের অবস্থা
আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদের প্রত্যেকে তা (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে। এটা তোমার রবের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।’ (সুরা, মারিয়াম, আয়াত : ৭১)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতি তাকি ওসমানি বলেন, এর দ্বারা পুলসিরাত বোঝানো হয়েছে, যা জাহান্নামের ওপর স্থাপিত। মুসলিম-কাফির ও পুণ্যবান-পাপিষ্ঠ-নির্বিশেষে সবাইকে তা পার হতে হবে। হ্যাঁ, পার হতে গিয়ে তার অবস্থা কেমন হবে তা পরবর্তী আয়াতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মুমিন ও নেককার লোক তো এমনভাবে পার হবে যে জাহান্নামে কোনো কষ্ট তাদের স্পর্শ করবে না। তারা নিরাপদে তা পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে। পক্ষান্তরে যারা কাফের ও পাপী, তারা তা পার হতে পারবে না। তারা জাহান্নামে পতিত হবে। (তাওজিহুল কোরআন ২/৩২২)
তাই পুলসিরাতের এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে নেক আমলের বিকল্প নেই।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই কঠিন শাস্তি থেকে নিরাপদ রাখুন।